স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৯ : কিছু টুকরো ঘটনা বাকস্বাধীনতার মূল্য / 独立の思い出19 一部の作品は言論の自由の価値があります
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৯
কিছু টুকরো ঘটনা বাকস্বাধীনতার মূল্য
আজ জুন ৬, ২০২০ ইন্ডিয়ার একটা টেলিভিশন প্রোগ্রাম দেখছিলাম। সেখানে ইন্দিরা আহমেদ নামে এক মহিলা প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছে। প্রথমে একটু আশ্চর্য্যই মনে হল। কারন নামের অর্ধেকটা হল হিন্দু, আর অর্ধেকটা হল মুসলিম। এ কেমন করে হয়? আমরা জানি, বিশেষ করে কোন মুসলিম পরিবার অমুসলিম জামাই বা বউকে মেনে নেয়না। তেমনি ভাবেই একজন হিন্দু পরিবার মুসলিম জামাই বা বউকে মেনে নিতে পারেনা। যদি একান্তই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়, তাহলে যে কোন একজনকে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে অপরের ধর্ম গ্রহন করতে হয়। শুধু ধর্মই নয়, তার বাবা মা, আত্মীয় স্বজনকেও তাগ করতে হয়। সমস্ত উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আবার বাবা মার আদর করে দেওয়া নামটাও পরিবর্তন করে নতুন নাম অর্জন করতে হয়। আমরা দেখেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিন্দু মেয়েরা মুসলমান ছেলেদের হাত ধরে রাতের অন্ধকারে বের হয়ে আসে এক অজানা পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য। শুধু ভালোবাসা-ই একমাত্র ভরসা। কোর্টে অথবা বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতায় কারো বাড়িতে ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে বিয়ের কাজটা সেরে নেয়।
আমরা তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভবত অনার্স শেষ বর্ষ অথবা এম এ র ছাত্র। আমাদের এক শিক্ষক জনাব শহিদুল্লাহ সাহেব বিয়ে করলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন খুব সুন্দরী এবং মিশুক হিন্দু পরিবারের এক বড় আপু কে। আমরা সবাই জানতাম এই দুই যুগলের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আপুর বড় ভাইও কিন্তু একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু ওই বিয়েটাও করতে হয়েছিল জুবেরি ভবনে (গেস্ট হাউজ), আর বিয়েটা পড়িয়েছিলেন এস এম হলের মসজিদের ইমাম সাহেব। আপুর বড় ভাই কি মনে করেছিলেন জানিনা, কিন্তু উনার মা এটাকে মেনে নিতে পারেন নাই। আপুকে নাম পরিবর্তন করতে হয়েছিল, বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে শুধুমাত্র বরের বন্ধু বান্ধবের উপস্থিতিতে বিয়েটা সম্পন্ন করতে হয়েছিল।
আরেকটি ঘটনাও উল্লেখ করতে হয়। জনাব হাসিবুল হাসান সাহেব। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। দীর্ঘ দিন ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন। বিয়ে করেছেন একজন ব্রিটিশকে। উনার দুই মেয়ে। আমরা কেউ কোনোদিন উনার আগে ছালাম দিতে পারিনাই। স্যার সর্বদা আমাদের আগেই ১০০ গজ দূর থেকে ছালাম দিতেন, এবং একবার নয়, বহুবার। একদিন আমরা ক্লাস শেষে হলে ফিরলাম দুপুরে লাঞ্চ করার জন্য। কিছু সময় পরে শুনলাম স্যার ডিপার্টমেন্টেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। উনার বাড়ি হচ্ছে কামারখালি, নদীর খুব কাছাকাছি। স্যারের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। দুইজন শিক্ষক এবং আমরা চার পাঁচ জন ছাত্র। পরদিন ফিরে এলাম রাজশাহিতে। কয়েকদিন পর স্যারের আত্মার মাগফেরাতের জন্য ছোট একটা মিলাদ মাহফিল। আমরা মাহফিলে যোগ দিলাম। কিন্তু স্যারের স্ত্রী এলেন না। আমাদের কয়েকজন বান্ধবি স্যারের বাসায় গেলেন, ম্যাডামকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি যোগ দিবেন কিনা। ম্যাডাম বললেন আমি তো খৃস্টান, আর তোমাদের স্যার মুসলমান। আমি দুতলার বেলকনি থেকে দোয়া করব। তখনই আমরা প্রথম শুনলাম দুই ধর্মের দুই ব্যাক্তি একসাথে দীর্ঘ দিন সংসার করছেন। এখানে তাদের চলার পথে ধর্ম কখনই অন্তরাই হয়ে দাড়াই নাই। কেন এটা সম্ভব হয়েছে? এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র একে অপরের ধর্মীয় চিন্তাভাবনা, চিন্তাচেতনা কে সম্মান করার জন্য, কারোর উপর নিজের মতামত কে চাপিয়ে না দেওয়ার জন্য।
এবার আমার পরিবার সম্পর্কে কিছু কথা বলি। আমার ছেলে ১৯ বছর বয়সে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে। এখন তার বয়স ৪০। সে এখন আমেরিকান একজন মেয়েকে বিয়ে করে সুখের সংসার করছে। বউমা কোনদিন মদ খাই নাই, কোন দিন শুয়রের মাংস খাই নাই। আমার ২৮ বছরের মেয়ে জাপানে জন্ম এবং একজন জাপানী ছেলেকে বিয়ে করেছে। জামাই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে ইসলামিক নিয়মে তার বাবা মার উপস্থিতিতে এবং অনেক বাংলাদেশিদের সামনে স্থানীয় মসজিদে বিয়ে করেছে। বিয়ের আগে ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ছেলের নাম পরিবর্তন করা লাগবে কিনা। ইমাম সাহেব বললেন, কেন তার বাবা মার দেওয়া নাম পরিবর্তন করতে হবে? নামের সাথে ধর্মের আদৌ কোন সম্পর্ক নাই। ইন্দনেশিয়ার লোকজনের নাম শুনে সে মুসলিম না অন্য ধর্মের এটা বুঝা কঠিন। আমার মেয়ে জামাই নিয়ে যখন বাংলাদেশে গেলাম, তখন দেখলাম আমার ভাইবোন বা আত্মীয় সজনের অনেকেই এই বিয়েটাকে সহজ ভাবে নিতে পারে নাই।
এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে আমরা কিভাবে রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বিকে গ্রহন করে, তার মতকে সাম্মান দিয়ে একসাথে কাজ করব? আমাদের যেহেতু হাত আছে, তাহলে কেন কথার যুদ্ধ করব? কেউ যদি ভিন্ন মত প্রকাশ করে, তাহলেই আমরা নামের পাশে একটা বিশেষণ যোগ করে দিই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও এর কোন ব্যতিক্রম হয় নাই।
আমাদেরই মুক্তি বাহিনীর জনৈক সদস্য আমাদের গ্রামের মধ্য বয়সের একজন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত। কারন হল সেই ব্যাক্তি আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করত। মতের বা আদর্শের মিল না থাকা তো কিছু অপরাধ নয়, বরং সেটাই স্বাভাবিক। আর ভিন্ন মত আছে বলেই তো নিজকে চেনা যায়, নিজের ভুল ভ্রান্তি সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়। আমি সেই মুক্তিযোদ্ধাকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে তার মতে অটল। আমরা সেদিন ব্রজনাথপুরে ছিলাম। সেই মুক্তিযোদ্ধা তার রাইফেলটি ঘাড়ে নিয়ে রওয়ানা দিল। আমি তাকে সতর্ক করে বললাম, আমিও কিন্তু তোর পিছন পিছন আসছি, এবং রাইফেলে গুলি ভর্তি করে। তুই যদি একটা গুলি ছাড়িস, তবে আমি তোর বুকে দুইটা গুলি মারব।
মুক্তি বাহিনীর কাজই তো হল এধরনের মানুষকে বোঝানো, উদবুদ্ধকরন, কেন আমরা যুদ্ধ করছি সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা দেওয়া। কিন্তু আমরা যদি কোন ভিন্ন মতামতের ব্যক্তিকে জোরপূর্বক আমার মতের সাথে একমত করানোর চেষ্টা করি, এবং বাধ্য করি, তাহলে পাক সরকারের সাথে আমাদের পার্থক্য কোথায়? আমরা কি আমাদের উপর প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল? এই প্রশ্ন গুলোই আমার মনের মধ্যে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল।
সে আমার আগেই বের হল। আমি কয়েক মিনিট পরে বের হলাম। আমার সামনে কয়েকটা কঠিন জায়গা ছিল। প্রথমটি গরিবপুরের রবকুল ডাক্তারের বাড়ির নিকট কলাগাছের ভেলায় বিল পাড়ি দেওয়া। আমি কখনো নিজে ভেলা চালাই নাই। যেহেতু আমাকে সামনে যেতেই হবে, তাই চেষ্টা করলাম সর্ব শক্তি দিয়ে। শেষ পর্যন্ত সফল হলাম। সামনে অগ্রসর হতে থাকলাম। রাত আনুমানিক ১০টা। দ্বিতীয়টি করমদি হাইস্কুলের প্রাক্তন ফুটবল মাঠ, সেখানে কাছাকাছি রাস্তার পার্শে একটা বট গাছ ছিল। এই গাছটিও ছিল আমার কাছে ভয়ঙ্কর। আর তৃতীয়টি হল জলিল চাচার বাগান।
গোসাইডুবি এবং গরিবপুরের মাঝখানে অনেক বড় একটা আম বাগান ছিল। একটু সন্ধ্যা হলেই বাগানের এপার থেকে ওপার পর্যন্ত দেখা যেত না। আর এই বাগানের এক অংশে অত্র এলাাকার সবচেয়ে পুরাতন মসজিদ ছিল এবং আছে। মসজিদের ছাদ ভেঙ্গে ভেংগে পড়ছে, দেওয়াল ভেদ করে একটি বটগাছ। এই গাছটি যেন চারিদিকে ছড়িয়ে যেয়ে তার প্রিয়াকে সমস্ত শক্তি দিয়ে বহিরশক্তির সাথে যুদ্ধ করে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। যেহেতু বাইরে থেকে সূর্যের তাপ আসে না, তাই সব সময় যেন পানি পড়তে থাকে, আর কেমন যেন একটা শব্দ শোনা যেত। বিভিন্ন রংগের পাখিগুল যেন আনন্দে মেতে থাকে। দিনের বেলাতেও ঐ মসজিদের কাছাকাছি যেতে ভয় করত। রাত্রি বেলাতে তো প্রশ্নই উঠে না। শুনেছি ঐ ভাংগা মসজিদের ভিতর বড় বড় অজগর সাপ, বন্য জন্তু বাস করত। আদৌ ছিল কিনা জানিনা, তবে ভয়ে ওর কাছেও যেতাম না।
এই বাগানটি আমাকে একাই পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু আমার একটুও ভয় হল না। শুধুমাত্র আমার সাথে একটা রাইফেল ছিল বলে এবং একজন লোককে তার মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবো বলে। আমি সেই বাড়িতে যেয়ে দেখি মুক্তিযোদ্ধা ঐ ব্যক্তিকে সামনে নিয়ে বসে কথা বলছে। তখনও তাকে গুলি করে নাই। ঐ চিত্র দেখে বরং কিছুটা আসশস্ত হলাম। রাইফেলটি মুক্তিযোদ্ধার দুই পায়ের মাঝখানে, ঘাড়ের উপর পর্যন্ত। আমিও যেয়ে তাদের সাথে একত্রিত হলাম। আমি কোন পক্ষ না নিয়ে বরং বাংলাদেশের কেন স্বাধীনতা প্রয়োজন, আমরা কেন আজ অস্ত্র হাতে নিয়েছি, কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখান ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, রাত্রিতে নিজ বাড়িতে থাকতে পারছিনা, ইত্যাদি, ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত সেই লোক আমার কথার সাথে একমত হল। আমরা দুজন আবারো ব্রজনাথপুর ক্যাম্পে ফিরে এলাম।
আমার একটাই সান্ত্বনা, আমার গুলিতে কেউ নিহত হলনা, আর কাউকে নিহত করার সুযোগও দিলাম না। শান্তিপূর্ণ সমাধান। বিনা রক্তে।
আজ এখানেই শেষ ১০ই জুন, ২০২০
copyright from Facebok ID
কিছু টুকরো ঘটনা বাকস্বাধীনতার মূল্য
আজ জুন ৬, ২০২০ ইন্ডিয়ার একটা টেলিভিশন প্রোগ্রাম দেখছিলাম। সেখানে ইন্দিরা আহমেদ নামে এক মহিলা প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছে। প্রথমে একটু আশ্চর্য্যই মনে হল। কারন নামের অর্ধেকটা হল হিন্দু, আর অর্ধেকটা হল মুসলিম। এ কেমন করে হয়? আমরা জানি, বিশেষ করে কোন মুসলিম পরিবার অমুসলিম জামাই বা বউকে মেনে নেয়না। তেমনি ভাবেই একজন হিন্দু পরিবার মুসলিম জামাই বা বউকে মেনে নিতে পারেনা। যদি একান্তই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়, তাহলে যে কোন একজনকে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে অপরের ধর্ম গ্রহন করতে হয়। শুধু ধর্মই নয়, তার বাবা মা, আত্মীয় স্বজনকেও তাগ করতে হয়। সমস্ত উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আবার বাবা মার আদর করে দেওয়া নামটাও পরিবর্তন করে নতুন নাম অর্জন করতে হয়। আমরা দেখেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিন্দু মেয়েরা মুসলমান ছেলেদের হাত ধরে রাতের অন্ধকারে বের হয়ে আসে এক অজানা পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য। শুধু ভালোবাসা-ই একমাত্র ভরসা। কোর্টে অথবা বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতায় কারো বাড়িতে ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে বিয়ের কাজটা সেরে নেয়।
আমরা তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভবত অনার্স শেষ বর্ষ অথবা এম এ র ছাত্র। আমাদের এক শিক্ষক জনাব শহিদুল্লাহ সাহেব বিয়ে করলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন খুব সুন্দরী এবং মিশুক হিন্দু পরিবারের এক বড় আপু কে। আমরা সবাই জানতাম এই দুই যুগলের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আপুর বড় ভাইও কিন্তু একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু ওই বিয়েটাও করতে হয়েছিল জুবেরি ভবনে (গেস্ট হাউজ), আর বিয়েটা পড়িয়েছিলেন এস এম হলের মসজিদের ইমাম সাহেব। আপুর বড় ভাই কি মনে করেছিলেন জানিনা, কিন্তু উনার মা এটাকে মেনে নিতে পারেন নাই। আপুকে নাম পরিবর্তন করতে হয়েছিল, বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে শুধুমাত্র বরের বন্ধু বান্ধবের উপস্থিতিতে বিয়েটা সম্পন্ন করতে হয়েছিল।
আরেকটি ঘটনাও উল্লেখ করতে হয়। জনাব হাসিবুল হাসান সাহেব। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। দীর্ঘ দিন ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন। বিয়ে করেছেন একজন ব্রিটিশকে। উনার দুই মেয়ে। আমরা কেউ কোনোদিন উনার আগে ছালাম দিতে পারিনাই। স্যার সর্বদা আমাদের আগেই ১০০ গজ দূর থেকে ছালাম দিতেন, এবং একবার নয়, বহুবার। একদিন আমরা ক্লাস শেষে হলে ফিরলাম দুপুরে লাঞ্চ করার জন্য। কিছু সময় পরে শুনলাম স্যার ডিপার্টমেন্টেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। উনার বাড়ি হচ্ছে কামারখালি, নদীর খুব কাছাকাছি। স্যারের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। দুইজন শিক্ষক এবং আমরা চার পাঁচ জন ছাত্র। পরদিন ফিরে এলাম রাজশাহিতে। কয়েকদিন পর স্যারের আত্মার মাগফেরাতের জন্য ছোট একটা মিলাদ মাহফিল। আমরা মাহফিলে যোগ দিলাম। কিন্তু স্যারের স্ত্রী এলেন না। আমাদের কয়েকজন বান্ধবি স্যারের বাসায় গেলেন, ম্যাডামকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি যোগ দিবেন কিনা। ম্যাডাম বললেন আমি তো খৃস্টান, আর তোমাদের স্যার মুসলমান। আমি দুতলার বেলকনি থেকে দোয়া করব। তখনই আমরা প্রথম শুনলাম দুই ধর্মের দুই ব্যাক্তি একসাথে দীর্ঘ দিন সংসার করছেন। এখানে তাদের চলার পথে ধর্ম কখনই অন্তরাই হয়ে দাড়াই নাই। কেন এটা সম্ভব হয়েছে? এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র একে অপরের ধর্মীয় চিন্তাভাবনা, চিন্তাচেতনা কে সম্মান করার জন্য, কারোর উপর নিজের মতামত কে চাপিয়ে না দেওয়ার জন্য।
এবার আমার পরিবার সম্পর্কে কিছু কথা বলি। আমার ছেলে ১৯ বছর বয়সে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে। এখন তার বয়স ৪০। সে এখন আমেরিকান একজন মেয়েকে বিয়ে করে সুখের সংসার করছে। বউমা কোনদিন মদ খাই নাই, কোন দিন শুয়রের মাংস খাই নাই। আমার ২৮ বছরের মেয়ে জাপানে জন্ম এবং একজন জাপানী ছেলেকে বিয়ে করেছে। জামাই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে ইসলামিক নিয়মে তার বাবা মার উপস্থিতিতে এবং অনেক বাংলাদেশিদের সামনে স্থানীয় মসজিদে বিয়ে করেছে। বিয়ের আগে ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ছেলের নাম পরিবর্তন করা লাগবে কিনা। ইমাম সাহেব বললেন, কেন তার বাবা মার দেওয়া নাম পরিবর্তন করতে হবে? নামের সাথে ধর্মের আদৌ কোন সম্পর্ক নাই। ইন্দনেশিয়ার লোকজনের নাম শুনে সে মুসলিম না অন্য ধর্মের এটা বুঝা কঠিন। আমার মেয়ে জামাই নিয়ে যখন বাংলাদেশে গেলাম, তখন দেখলাম আমার ভাইবোন বা আত্মীয় সজনের অনেকেই এই বিয়েটাকে সহজ ভাবে নিতে পারে নাই।
এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে আমরা কিভাবে রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বিকে গ্রহন করে, তার মতকে সাম্মান দিয়ে একসাথে কাজ করব? আমাদের যেহেতু হাত আছে, তাহলে কেন কথার যুদ্ধ করব? কেউ যদি ভিন্ন মত প্রকাশ করে, তাহলেই আমরা নামের পাশে একটা বিশেষণ যোগ করে দিই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও এর কোন ব্যতিক্রম হয় নাই।
আমাদেরই মুক্তি বাহিনীর জনৈক সদস্য আমাদের গ্রামের মধ্য বয়সের একজন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত। কারন হল সেই ব্যাক্তি আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করত। মতের বা আদর্শের মিল না থাকা তো কিছু অপরাধ নয়, বরং সেটাই স্বাভাবিক। আর ভিন্ন মত আছে বলেই তো নিজকে চেনা যায়, নিজের ভুল ভ্রান্তি সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়। আমি সেই মুক্তিযোদ্ধাকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে তার মতে অটল। আমরা সেদিন ব্রজনাথপুরে ছিলাম। সেই মুক্তিযোদ্ধা তার রাইফেলটি ঘাড়ে নিয়ে রওয়ানা দিল। আমি তাকে সতর্ক করে বললাম, আমিও কিন্তু তোর পিছন পিছন আসছি, এবং রাইফেলে গুলি ভর্তি করে। তুই যদি একটা গুলি ছাড়িস, তবে আমি তোর বুকে দুইটা গুলি মারব।
মুক্তি বাহিনীর কাজই তো হল এধরনের মানুষকে বোঝানো, উদবুদ্ধকরন, কেন আমরা যুদ্ধ করছি সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা দেওয়া। কিন্তু আমরা যদি কোন ভিন্ন মতামতের ব্যক্তিকে জোরপূর্বক আমার মতের সাথে একমত করানোর চেষ্টা করি, এবং বাধ্য করি, তাহলে পাক সরকারের সাথে আমাদের পার্থক্য কোথায়? আমরা কি আমাদের উপর প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল? এই প্রশ্ন গুলোই আমার মনের মধ্যে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল।
সে আমার আগেই বের হল। আমি কয়েক মিনিট পরে বের হলাম। আমার সামনে কয়েকটা কঠিন জায়গা ছিল। প্রথমটি গরিবপুরের রবকুল ডাক্তারের বাড়ির নিকট কলাগাছের ভেলায় বিল পাড়ি দেওয়া। আমি কখনো নিজে ভেলা চালাই নাই। যেহেতু আমাকে সামনে যেতেই হবে, তাই চেষ্টা করলাম সর্ব শক্তি দিয়ে। শেষ পর্যন্ত সফল হলাম। সামনে অগ্রসর হতে থাকলাম। রাত আনুমানিক ১০টা। দ্বিতীয়টি করমদি হাইস্কুলের প্রাক্তন ফুটবল মাঠ, সেখানে কাছাকাছি রাস্তার পার্শে একটা বট গাছ ছিল। এই গাছটিও ছিল আমার কাছে ভয়ঙ্কর। আর তৃতীয়টি হল জলিল চাচার বাগান।
গোসাইডুবি এবং গরিবপুরের মাঝখানে অনেক বড় একটা আম বাগান ছিল। একটু সন্ধ্যা হলেই বাগানের এপার থেকে ওপার পর্যন্ত দেখা যেত না। আর এই বাগানের এক অংশে অত্র এলাাকার সবচেয়ে পুরাতন মসজিদ ছিল এবং আছে। মসজিদের ছাদ ভেঙ্গে ভেংগে পড়ছে, দেওয়াল ভেদ করে একটি বটগাছ। এই গাছটি যেন চারিদিকে ছড়িয়ে যেয়ে তার প্রিয়াকে সমস্ত শক্তি দিয়ে বহিরশক্তির সাথে যুদ্ধ করে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। যেহেতু বাইরে থেকে সূর্যের তাপ আসে না, তাই সব সময় যেন পানি পড়তে থাকে, আর কেমন যেন একটা শব্দ শোনা যেত। বিভিন্ন রংগের পাখিগুল যেন আনন্দে মেতে থাকে। দিনের বেলাতেও ঐ মসজিদের কাছাকাছি যেতে ভয় করত। রাত্রি বেলাতে তো প্রশ্নই উঠে না। শুনেছি ঐ ভাংগা মসজিদের ভিতর বড় বড় অজগর সাপ, বন্য জন্তু বাস করত। আদৌ ছিল কিনা জানিনা, তবে ভয়ে ওর কাছেও যেতাম না।
এই বাগানটি আমাকে একাই পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু আমার একটুও ভয় হল না। শুধুমাত্র আমার সাথে একটা রাইফেল ছিল বলে এবং একজন লোককে তার মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবো বলে। আমি সেই বাড়িতে যেয়ে দেখি মুক্তিযোদ্ধা ঐ ব্যক্তিকে সামনে নিয়ে বসে কথা বলছে। তখনও তাকে গুলি করে নাই। ঐ চিত্র দেখে বরং কিছুটা আসশস্ত হলাম। রাইফেলটি মুক্তিযোদ্ধার দুই পায়ের মাঝখানে, ঘাড়ের উপর পর্যন্ত। আমিও যেয়ে তাদের সাথে একত্রিত হলাম। আমি কোন পক্ষ না নিয়ে বরং বাংলাদেশের কেন স্বাধীনতা প্রয়োজন, আমরা কেন আজ অস্ত্র হাতে নিয়েছি, কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখান ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, রাত্রিতে নিজ বাড়িতে থাকতে পারছিনা, ইত্যাদি, ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত সেই লোক আমার কথার সাথে একমত হল। আমরা দুজন আবারো ব্রজনাথপুর ক্যাম্পে ফিরে এলাম।
আমার একটাই সান্ত্বনা, আমার গুলিতে কেউ নিহত হলনা, আর কাউকে নিহত করার সুযোগও দিলাম না। শান্তিপূর্ণ সমাধান। বিনা রক্তে।
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৯
কিছু টুকরো ঘটনা বাকস্বাধীনতার মূল্য
|
আজ এখানেই শেষ ১০ই জুন, ২০২০
copyright from Facebok ID
No comments