স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৭ : ট্রেনিং সেন্টার নির্ধারণ Some memories of independence 17

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৭
Some memories of independence 16

ট্রেনিং সেন্টার নির্ধারণ 
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৭  Some memories of independence 16     ট্রেনিং সেন্টার নির্ধারণ our karamdi.ml

এখানে ট্রেনিং শব্দটা ব্যাবহার করেছি, কিন্তু এটা আদৌ যুক্তিযুক্ত কিনা সে নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব আছে। ট্রেনিং বলতে সাধারনভাবে যেটা বোঝায় সেটা হল নির্দিষ্ট কারিকুলাম থাকবে, সিকুয়েঞ্চ থাকবে,  ট্রেনার   থাকবে, ট্রেনিংস্থল থাকবে, ট্রেনিংয়ের যন্ত্রপাতি থাকবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের কোনটাই নাই। এই নাই দিয়েই আমাদের যাত্রা। 
 
এখন প্রশ্ন হল তাহলে আমরা কি করব? কোথায় করব? কারা আমাদের ক্লায়েন্ট বা মক্কেল? আমাদের বিশ্বস্ত ক্লায়েন্ট কি আছে? আর বিশ্বস্ত ক্লায়েন্ট যদি না থাকে, সেটা হবে আরও বিপদজনক। আমরা আপাততঃ করমদি এবং মিনাপাড়া গ্রাম বা তৎএলাকাকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বলা যায় নাড়ির টানেই এটা হয়ে গেছে। দুটি এলাকাকে বেছে নেওয়ার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। করমদি গ্রাম থেকেই আমরা ৩জন মুজিব বাহিনীর সদস্য। এই অঞ্চল সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট ধারনা আছে। রাস্তাঘাট, লোকজন, বাড়িঘর ইত্যাদি আমাদের চেনা। অত্র এলাকার লিডারদেরকেও আমরা চিনি। বিশেষ করে তখনকার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নুরুল হুদা সাহেব, করমদি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব ইদ্রিস সাহেব (হেড স্যার) আমাদের সাথেই আছেন। ১৯৬০ দশকের শেষ দিকে আমরা যখন করমদি হাইস্কুলের ছাত্র, সেসময়েই ছাত্র আন্দোলন খুব জোরদার হয়ে উঠে। শুধু শহরেই নয়, গ্রাম এলাকাতেও তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় হেড স্যার নিজ থেকে ছাত্র আন্দোলনের একটা অংশ হিসাবে মিটিং মিছিলে যোগদান বা পরিচলনার জন্য আমাদেরকে নিষেধ তো নয়ই, বরং উৎসাহিত করেছেন। তাঁর এই কাজ ছিল সম্পূর্ণ সরকার বিরোধী। অথচ উনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, চাকরির ঝুঁকি নিয়ে সরকারের পক্ষে না যেয়ে বিরোধিতা করতে সচেষ্ট হয়ে পড়েন। তারা দুজনই আওয়ামী লীগের কট্টর এবং জোরালো সমর্থক। তাদের থেকে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা পাব সেটাই স্বাভাবিক। এছাড়া ইন্ডিয়া আমাদের খুব কাছে। মাত্র কয়েক কিলো দূরত্ব। বর্ডার পর্যন্ত হেঁটে যেতে খুব বেশী সময় লাগবেনা। প্রয়োজনে সাময়িক সহযোগিতা নেওয়ার জন্য ইন্ডিয়ার ভিতরে আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। বাস্তবে ব্রজনাথপুরে একটা শরণার্থী ক্যাম্প ছিল। সেখানে আমাদের গ্রামের এবং আশেপাশের গ্রাম থেকে অনেকেই জমি ধার করে নিয়ে কুঁড়েঘর বানিয়ে সেখানে রাত যাপন শুরু করেছে। 

এই ক্যাম্পেই একজন ব্যাক্তির সাথে পরিচয় হয় যার সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। তিনি হচ্ছেন নওদাপাড়া গ্রামের প্রয়াত আব্দুল কুদ্দুস সাহেব, তৎকালীন গাংনী থানা কাউন্সিলের হেড ক্লার্ক। তিনিও ঐ একই ক্যাম্পে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন। এর পিছনে একটা কারন ছিল। তাঁর শ্বশুর ব্রজপুরের নিকটবর্তী হাড়াভাংগা  গ্রামের  প্রয়াত গ্রাম ডাক্তার জনাব ওয়াজেদ আলী সাহেব। খুব পাতলা হাল্কা মানুষ, কিন্তু কণ্ঠ ছিল খুব উঁচু। কট্টর আওয়ামীলিগার। তাঁর কথা শুনতে মাইক প্রয়োজন হতনা। ১৯৬৯ সালের কোন একদিন তেতুলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে সরকার বিরোধী গণজাগরণের জন্য জনসভা। অত্র এলাকার নেতাগন সকলেই উপস্থিত। একের পর এক মঞ্চে উঠে বক্তৃতা করছেন। পালা এল ওয়াজেদ সাহেবের। উনার পায়ে ছিল চামড়ার স্যান্ডেল। মঞ্চে উঠেই পায়ের স্যান্ডেল জোড়া খুলে প্রথমে হাতে নিলেন, পরে মুখে কামড়ে ধরলেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, আমরা কুকুর নই, আর পাকিস্তানের পোষা কুকুর হিসাবে থাকতেও চাইনা। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে চাই। চারিদিক থেকে হাততালিতে ভরে উঠল জনসভার মাঠ। আমরা যদিও তখন বয়সে ছোট, কিন্তু জনসভা থেকে বেরিয়ে আসা জনগনের কণ্ঠস্বর কি যে বলতে চাই সেটা বোঝার বয়স হয়েছিল, আমরাও যেন সাময়িক ভাবে হলেও ভিন্ন জগতে চলে গিয়েছিলাম। এমন একজন মানুষের জামাই হচ্ছেন আব্দুল কুদ্দুস সাহেব, একজন সরকারী কর্মকর্তা। তাই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই কুদ্দুস সাহেব বুঝতে পেরেছেন যে গাংনিতে অবস্থান করা আর সমীচীন হবেনা। তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত গ্রহন, গাংনী ত্যাগ। শেষমেশ ব্রজনাথপুর শরণার্থী ক্যাম্পে। আর সেখানেই উনার সাথে আমাদের পরিচয়। আমাদের সাথে রাজনৈতিক কথাবার্তা ছাড়াও নিত্য দিনের আলাপও হতো। কুদ্দুস সাহেব জাল দিয়ে মাছ ধরতে পছন্দ করতেন। ব্রজনাথপুরের আশে পাশে ছিল অনেক বিল, নিচু জায়গা। ঐ বছর প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার জন্য যত্রতত্র প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। কুদ্দুস সাহেব মাঝে মাঝে আমাদেরকেও মাছের কিছু অংশ দিতে ভুল করেননি। শরণার্থী ক্যাম্পে হাড়াভাংগা, পিরতলা, সাহেবনগর, নওদাপাড়া ইত্যাদি গ্রামের লোকজন বাস করত। সেখানেই আমরা কুদ্দুস সাহেবের মাধ্যমে অনেক লোকের সাথে পরিচিত হই এবং আমাদের প্রধান যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে উদুদ্ধকরন, সেই কাজটাতে সার্থক হই। 

তেমনিভাবে করমদিতেও আমাদের একটা আখড়া ছিল। সেটা হল গোসাইডুবি পাড়ার মান্নান ভাইদের বাড়িতে। এখানেও ঠিক কুদ্দুস সাহেবের ন্যায় ঢাকা থেকে আত্মরক্ষার জন্য সন্তান সন্ততি নিয়ে চলে এসেছেন মান্নান ভাইয়ের বড় ভাই অর্থাৎ আব্দুল গনি মিয়া। ৬০ এর দশকে যে দুইজন ব্যাক্তি করমদি গ্রাম ত্যাগ করে ঢাকায় গিয়েছিলেন তাদের একজন হচ্ছেন গনি মিয়া। উনার নামের সাথে কেন মিয়া শব্দটি যোগ করা হয়েছিল সেটা অদ্দাবধি অজানা। গনি ভাইও ছিলেন আওয়ামীপন্থী, তিনিও তাঁর বাড়িটাকে ছেড়ে দিলেন আমাদের ব্যাবহারের জন্য।

করমদি পশ্চিম পাড়ার মোজাম্মেলদের বাড়িটা ছিল আমাদের আরেকটা ঘাঁটি। আমরা সেখানেও মাঝে মাঝে রাত যাপন করেছি। গ্রামের বিশেষ করে যুবকদের সাথে যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করেছি।  বলে রাখা বাঞ্ছনীয় যে মোজাম্মেল নিজে মুক্তিযোদ্ধা, সেজন্য টীম মেম্বার হিসাবে তার সরাসরি যোগদান। এছাড়া ঐ একই পাড়া থেকে ইয়ামিন, রেজাউল এবং মীর বক্তিয়ার ছিল মুক্তিযোদ্ধা। মোজাম্মেলদের বাড়িটা হচ্ছে একটা নদীর পাড়ে, চারিদিকে ফাঁকা বললেই চলে। অনেকটা গোপনীয়তা বজায় রাখা সম্ভব ছিল।

মিনাপাড়াতে আমাদের একটা ট্রেনিং সেন্টার ছিল। মিনাপাড়া এবং মানিকদিয়া গ্রামের মধ্যস্থলে অবস্থিত একটা ঈদগাহ মাঠ। লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে, আশেপাশে কাঁঠাল বাগান, ধান ক্ষেত, আঁখ ক্ষেত, গরুর খাবারের জন্য গ্যামা ক্ষেত। বাইরে থেকে সহজে দেখা যেত না। প্রয়োজনে নিজকে গোপন করে রাখার মত জায়গা। সেখানে অলৌকিক ভাবে কিছু যুবকদের সাথে পরিচয় হল। সকলের নাম যদিও মনে নাই, তবে নিম্নোক্ত ব্যাক্তিগুলো উল্লেখযোগ্য, যেমন প্রয়াত আব্দুল কুদ্দুস, ইয়াছিন (পরবর্তীতে গ্রাম ডাক্তার), কমরেড জালাল সাহেব এবং তার ছোট ভাইগুলো, শিমুলতলা গ্রামের খালেক উল্লেখযোগ্য। মিনাপাড়াতে আশরাফুলদের চাচাত ভাই দুলু ছিল আমাদের এ্যকটিভ মেম্বার।

বর্তমানে অনেকের নাম আমার মনে নাই, আশরাফুল অথবা অন্যান্য মেম্বারের সাথে আলোচনা করে এই অংশটা সংশোধন করব।

আজ এখানেই শেষ  ৪ঠা জুন, ২০২০

copyright from Facebook

No comments

Powered by Blogger.