স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৮ কিছু টুকরো ঘটনা আমাদের এলাকায় ঘটে যাওয়া কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরতে চাই.... 独立の思い出18 私たちの地域で起こったことのいくつかはここにあります

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৮

কিছু টুকরো ঘটনা    আমাদের এলাকায় ঘটে যাওয়া কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরতে চাই

আমি যখন নিজকে মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিই, তখনই মানুষ প্রশ্ন করে আমি কোথায় যুদ্ধ করেছি, কজন পাক বাহিনীর সেনা সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেছি? কিন্তু কখনই জিজ্ঞাসা করে না আমি কয়জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছি? আমরা পাকিস্তানীকে হত্যা করতে না পারলেও বাংলাদেশীকে হত্যা করেছি এমন অনেক নজীর আছে। ধরে নেওয়া হয়েছে আমরা কখনই বাংলাদেশীকে হত্যা করতে পারিনা। বাস্তবে কি তাই? আমাদের পাড়ার জারমান (জালাল) চাচাকে কারা হত্যা করেছিল? জার্মান চাচা হচ্ছে করমদি বহল পাড়ার হাজী গোলাম রসুলের বাবা। কিছুদিন পর তারই প্রতিশোধ হিসাবে একই পাড়ার ইব্রাহিমকে হত্যা করা হয়। প্রতিশোধ শব্দটা ব্যবহার করা উপযুক্ত হচ্ছে কিনা, আমার নিজের মধ্যেই প্রশ্ন আছে। তবে দুটো ঘটনা যে একেবারেই সম্পর্কহীন সেটাও বলা যাবেনা। একটাতে ব্যবহার করা হয় হ্যান্ড গ্রেনেড, অপরটিতে রাইফেল। এই অস্ত্রগুলো কোথা থেকে এল? নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে। রাজাকারদের হাতে অপরকে হত্যা করার জন্য তেমন কোন অস্ত্র দেওয়া হয়েছিলা কিনা আমার জানা নাই, আত্মরক্ষার জন্য একটা রাইফেল দেওয়া হয়ে থাকতে পারে, এর বেশী কিছু নয়। 

একটু বিস্তারিত না বললেই নয়। আমরা ইন্ডিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে আসার পূর্বের কোন এক রাতের ঘটনা। রাত বললে হয়তো ভুল বলা হবে। গ্রামের বাড়ি। একটু সন্ধ্যা হলেইতো অনেক রাত বলে মনে হয়। এখনকার মত বিদ্যুৎ নাই যে ঘরদোর আলোকিত থাকবে। সময়টা এশার নামাজের কিছু পর। জার্মান চাচা তার ছোট ছেলে  মোশারফ  কে নিয়ে বাইরের বৈঠকখানায় চৌকির উপর বিছানো বিছানায় একটু কাত হয়েছে, আর চাচী তার পাশে বসা।  মোশারফ  সম্ভবত ৫ বা ৬ বছর বয়স হবে। উজ্জ্বল ফর্সা, গদগদে চেহারা। যে কেউ তাকে কোলে টেনে নেওয়ার মত। গরমের দিন, তাই বিছানা বলতে লেপ কাঁথা নয়। হয়তো একটা কাঁথা আর একটা বালিশ। এমন সময় গর্জিয়ে উঠল গ্রেনেডের শব্দ। আর গ্রেনেডটি ছুঁড়ে মারা হয়েছিল দক্ষিন দিকের জানালার বাইরে থেকে। এক নিমিষেই জার্মান চাচা এবং তার কোমল শিশু ছেলেটি টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তাদের শরীরের মাংশপিণ্ড গুলো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। লাল রক্তে মাটির মেঝে হয়ে গেল লাল কার্পেট, আর বিছানা হয়ে গেল বাসর ঘর। ছেলেটির শরীরের কিছু কিছু টুকরা লাফাতে লাফাতে একসময় সারাজীবনের জন্য নিস্তেজ হয়ে গেল। ছেলেটি তখনো স্কুলে যায়নাই। এমন একটি নিস্পাপ শিশুর কি-ই বা অপরাধ ছিল?     

আর চাচীর গোটা শরীরে গ্রেনেডের টুকরা গুলো লজ্জাহিনভাবে ঢুকে গেল, কতটা টুকরা ছিল তার হিসাব কেই বা রাখে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অজানা অজানাই থেকে গেল। গোটা শরীর থেকে তাজা রক্ত বের হয়ে আসছে। আর সেই সাথে স্বামী এবং ছেলের রক্তে ডিজাইন করা কার্পেটের উপর চাচীর রক্তাক্ত শরীর শুধু এপাশ ওপাশ করে কণ্ঠ থেকে বের হয়ে আসা গোংড়ানি এক সময় থেমে গেল। আর সেই গোংড়ানি যেয়ে পৌছাল সৎছেলে গোলাম রসুলের কানে। অবস্থা দেখে সকলেই হতভম্ব। একদিকে বাবা এবং ছোট ভাইয়ের সৎকার, অপরদিকে মায়ের তড়িৎ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সেসময় গাংনীতেও হাসপাতাল তৈরি হয়নাই। মেহেরপুরে বর্তমান পৌরসভার নিকটে ছোট্ট একটা হাসপাতাল ছিল, কিন্তু তেমন কোন ভাল চিকিৎসার ব্যাবস্থা ছিল না। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে গরুর গাড়ীতে বামন্দি পর্যন্ত ৫ কিলো, সেখান থেকে বাসে মেহেরপুর প্রায় ২০ কিলো। সম্ভবত ঘণ্টায় একটি করে বাস। মেহেরপুরে সুষ্ঠু চিকিৎসা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গাতে চিকিৎসা করানো হয়। আর সমস্ত দায়িত্বটা সেচ্ছায় নিজ ঘাড়ে তুলে নিয়েছিল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সহকারী গোলাম ভাই। আমি অনেক বড় হয়ে জানতে পেরেছিলাম গোলাম ভাই চাচীর নিজ পেটে ধরা সন্তান নয়। অথচ তাদের মধ্যে এমন সম্পর্ক যে বাইরে থেকে কোনভাবেই বোঝা সম্ভব নয় যে তারা আপন মা বেটা নয়। খুবই বিরল, আজকের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা রোল মডেল।   

আর এতসব কাহিনি আমি শুনেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা হয়ে বাড়িতে ফিরে আসার পরদিন। হেডস্যার আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কিছু সময় পরই গোলাম ভাই আমাদের বাড়িতে আসে। চার দেওয়ালের মাঝখানে অন্ধকার ঘরে বসে চুপিচুপি চোখের পানি মুছতে মুছতে গোলাম ভাই এসব কথাগুলো আমাকে শুনিয়েছিল।

জানতে পেরেছিলাম এই দুর্ধর্ষ ঘটনার জন্য আমাদের পাড়ারই একজন দায়ী। যদিও তেমন কোন প্রমাণ যোগ্য সাক্ষ্যী ছিলনা। সকিছুই ছিল অনুমান। কিন্তু শেষে কি হল? এই অনুমানকে বিশ্বাস করে এমন একটা ঘটনা ঘটল যেটা কখনই পূরণীয় নয়। এ ঘটনাকেই কেন্দ্র করে কয়েকমাস পরে আরেকটা মার্ডার হল। কোন এক রাতদুপুরে কিছু লোক এসে তাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। করমদি হাড়াভাংগা গ্রামের মাঝখানে মাঠের মধ্যে তার লাশ পড়ে ছিল, পরদিন সকালে কৃষকরা ধানক্ষেতে খুঁজে পায় সেই অসাড় দেহটি। ঐদিন আমি গ্রাম থেকে দূরে থাকার জন্য ঐ ব্যাক্তির মরামুখ দেখতে যাওয়া সম্ভব হয়নাই। লোকমুখে শোনা কথা। ঐ ব্যক্তিকে গূলী করে হত্যা করা হয়। গুলিটা বুকের দিক থেকে ঢূকে পীঠের দিক দিয়ে বের হয়ে যায়, আর বের হওয়ার সময় বড় একটা গর্ত করে বের হয়। গুলীর নাকি এমনই স্বভাব। ছুঁই হয়ে ঢোকে ফাল হয়ে বের হয়।

কে মার্ডার হল, কে মার্ডার করল, আর কীভাবে মার্ডার হল এটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নয়। আমার মাথা ব্যথা হল আমরা যারা দেশকে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে  নিয়েছিলাম, সেই অস্ত্র কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটাকে নিয়ে। জার্মান চাচাকে হত্যা করা হল যে গ্রেনেড দিয়ে, ইব্রাহীম ভাইকে গূলী করে মারা হল যে রাইফেল দিয়ে, সেগুলো তো বাংলাদেশীকে নয়, বাংলাদেশের শত্রুকে পরাজিত করার জন্য। শত্রু হলেই যে তাকে মার্ডার করতে হবে, তেমনটিও নয়। শত্রুকে পরাজিত করাই আমাদের উদ্দেশ্য। আর সেজন্যই আমাদের হাতে অস্ত্র। যদি বিনা রক্তপাতে শত্রুকে পরাজিত করা যায়, এর চেয়ে ভাল কৌশল আর কি হতে পারে।

কিন্তু বাস্তবে কি হল? এই অস্ত্রগুলো আমার মতই মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে চলে গেল অন্যের হাতে, অপব্যবহারের জন্য। একটি মার্ডার দিয়েই কি এই রাইফেলটি অবসর নিয়েছিল? না জানি ঐ রাইফেলটি আরও কতবার ব্যবহৃত হয়েছিল? কত হাত বদল হয়েছিল?  কত মানুষের, কত পরিবারের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছেল? শুনেছি এগূলো নাকি রীতিমত বেচাকেনা হতো। অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ী মুক্তিযোদ্ধার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা গোষ্ঠীকেই বিরূপ কথাবার্তা শূনতে হয়। আমি কখনই এই চরম সত্যটাকে অস্বীকার করিনা, বরং মেনে নিয়ে আমি কি করেছি, কোন অন্যায় করেছি কিনা, আত্মসমালোচনার চেষ্টা করি।

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৮    কিছু টুকরো ঘটনা    আমাদের এলাকায় ঘটে যাওয়া কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরতে চাই our karamdi village
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৮

কিছু টুকরো ঘটনা    আমাদের এলাকায় ঘটে যাওয়া কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরতে চাই



  আজ এখানেই শেষ  ৬ই জুন, ২০২০
copyright fron facebok

No comments

Powered by Blogger.