স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৫

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৫   
 এপ্রিল ৩০, ২০২০ 
মুক্তিযুদ্ধ যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে সর্বদা। আমি আর অলস বসে থাকতে পারছি না। স্কুল কলেজ সব বন্ধ। স্কুল লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে পড়ব সে সুযোগও নাই। আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, বই কিনে পড়ার সংস্কৃতি তখনও তৈরি হয় নাই। আবার কোথাও যাওয়ার জায়গাও নাই। কৃষি কাজও করতে পারিনা। ছোট বেলা থেকে অভ্যাস নাই। ইতিমধ্যে কিছু লোক পাক বাহিনীর সাথে হাতে হাত মিলিয়েছে। এদেরই সহায়তাই পাক বাহিনীর গুলিতে কখন জীবনটা চলে যায় তারও কোন নিশ্চয়তা নাই। তাই শেষ মেশ নদিয়া জেলার করিমপুর থানার পথে রওয়ানা। এখানে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং ক্যাম্প আছে। মে মাসের মাঝামাঝি কোন এক সময়।  
করিমপুর থানা আমাদের গ্রাম থেকে ২০-২৫ কিলো দূরে। জলঙ্গী নদী বয়ে গেছে এই শহরের মধ্য দিয়ে। তবে বর্তমানে এই নদীর খোঁজ পাওয়া নাকি মুশকিল। শুধুমাত্র বর্ষাকালেই এর চেহারা সাময়িক ভাবে সাক্ষাত পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মতই জলঙ্গী নদী ভাগ হয়ে গেছে ভুমি দস্যুদের মধ্যে।  

বাড়ি থেকে অজানা অচেনা লক্ষ্যস্থলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া একজন পিতার জন্য, মায়ের জন্য, বা ভাই বোনের জন্য কত কষ্টকর সেটা আজ নিজে বাবা হয়ে বুঝতে পারি। ২০ বছরেরও বেশী সময় ধরে আমেরিকায় বসবাস রত ছেলেকে বিদায় দেওয়ার সময় এখনও নিজের অজান্তে চোখ দুটো ভিজে যায়। 
এবার বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। আমাদের গ্রাম থেকে আমি ছাড়া আরও কয়েকজন একসাথে রওয়ানা দিলাম। সকলের নাম মনে নাই, তবে প্রয়াত আব্দুল কাদের আমদের সাথে ছিল, এটা নিশ্চিত।  সাথে ছোট একটা টিনের সুট কেস। বোস্টন ব্যাগের সাথে তখনও পরিচিত নই। সুটকেসে আশ্রয় নিল কয়েকটি জামা, পাজামা (গ্রামের ছেলে, প্যান্ট পরার অভ্যাস তখনও হয় নাই( লুঙ্গি, গামছা ইত্যাদি।  

করিমপুর ক্যাম্পে পৌঁছালাম বিকাল বেলায়, আমাদেরকে ভর্তি করে নেওয়া হল এবং এক সেট খাকি কাপড় দেওয়া হল ট্রেনিংয়ের জন্য। আসলে এখানে শারীরিক এক্সারসাইজ ছাড়া আর কিছুই হতো না। যে ঘরে আমাদেরকে নেওয়া হল সেটা একটা গুদামঘর। জানালা দরজা নাই, একটা টয়লেট। অথচ আমরা শতাধিক লোক সেখানে আশ্রয় নিয়েছি। সকাল বেলায় বড় লাইনে দাঁড়াতে হয়। কারো যদি জরুরি ভিত্তিতে প্রাকৃতিক ডাক আসে, পেট খারাপ করে, তার জন্য মহাকাশের নীচে জলঙ্গি নদীর কিনারে অঢেল জায়গা পড়ে আছে। সেখানে নাকি অনেক বন্ধু বান্ধবও তৈরি হতো। কারোর দিকে তাকানো নিষেধ, নিজের কাজটা সেরে বিদায় লও। দুই সপ্তাহ কাটল এভাবে। 

একদিন আমাদের কয়েকজনকে ডাকা হল ইন্টারভিউ ফেস করার জন্য। এর ফলাফলের উপর নির্ভর করবে আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের ইন্টারভিউ নিলেন ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম, কুষ্টিয়া নিবাসী। পরবর্তীতে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি। উনার সাথে আরেক জন ছিলেন, নামটি মনে নাই। আমরা নির্বাচিত হলাম। এবার অনিশ্চিত জায়গার উদ্দেশে রওয়ানা দেওয়ার প্রস্তুতি। 

আমরা যেদিন করিমপুর ত্যাগ করব ঠিক তার আগের দিন সন্ধায় অভাবনীয় এক ব্যাক্তির আবির্ভাব। তিনি হলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি যাকে আমি আমার পিতার পরই স্থান দিয়ে এসেছি, করমদি হাইস্কুলের প্রয়াত প্রধান শিক্ষক আ ফ ম ইদ্রিস। স্যার আমাদেরকে নিয়ে একটা দোকানে ঢুকলেন। তোমাদের সাথে আবার কবে দেখা হবে ঠিক নাই, আসো একসাথে মিষ্টি খাই। জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার, কিভাবে জানতে পারলেন যে আমরা আগামীকাল এখান থেকে বিদায় নিব? স্যার বললেন আমি তোমাদের শিক্ষক নই? স্যার ইন্ডিয়ার এক ব্যক্তির ঠিকানা দিলেন, আর বললেন যদি কখনো সুযোগ হয়, চিঠি দিও। সেই সুযোগ আর হয় নাই। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক নতুন ভাবে অনুভব করলাম। শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করেছি সেই সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য।  

আজ এখানেই শেষ
mkstoryat2020
mkstoryat2020


Coppy from FB ID

No comments

Powered by Blogger.