স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৪

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৪
  সাময়িক ভাবে হলেও জন্মভুমি থেকে অচেনা ভিন দেশে পাড়ি
আমার জন্মভুমিতেই মৃত্যুর সাথে লড়াই করে দিন গুনব না ভিন দেশের মাটিতে যেয়ে কারোর আশ্রয় নিয়ে কিছুটা হলেও নিরাপদ জীবন যাপন করব, এটাই তখন বড় আলোচ্য বিষয় হয়ে দেখা দিল আমাদের পরিবারে। আর এই প্রশ্নটা আমার চেয়ে আমার বাবা বা ভাইদের মধ্যে বেশি করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল আমাদের দুই ভাইকে ভারতের এক পরিবারে আশ্রয়ের জন্য চেষ্টা করা। আমার ছোট ভাইটা আমার চেয়ে ২ বছরের ছোট, কিন্তু তাকে ছোট বেলা থেকেই আমার চেয়ে বড় মনে হতো। তাই আমার চেয়ে সেই-ই হয়তো পাকবাহিনীর নিকট বেশী আকর্ষণীয় হতে পারে, সেজন্যই তাকে আমার সাথে জুড়ে দেওয়া।

আমার নানা বাড়ি ভারতের গান্ধিনি  গ্রামে। আমার মার বিয়ে হয় সেই গ্রামেই এবং বড় ভাইয়ের জন্মও সেই গ্রামে। ভারত বিভক্ত হওয়ার পূর্বেই নানা সেখানেই মারা যাই, পরবর্তীতে দেশ ভাগের পর আমার নানী এবং মামা এপারে চলে আসে।  গান্ধিনি গ্রামে থেকে যায় নানাদের কিছু আত্মীয়ও স্বজন। আমার বাবা নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে সেই গ্রামটিকে বেছে নেয়। এপ্রিলের কোন এক দিন আমাদের দুই ভাইকে সেই গ্রামে নিয়ে যায় এবং আমাদের জন্য আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করে। আমাদের জন্য চাল ডাল বা অন্যান্য খরচপাতি দেওয়ার প্রতশ্রুতি করেও কোন ফল হল না। শেষ পর্যন্ত গ্রামে আবারো ফিরে এলাম। কিন্ত আমার কানে সর্বদা একটি শব্দই প্রতিফলিত হতে লাগলো, এভাবেই কি আমাকে শেষ দিনটার সম্মুখীন হতে হবে? আমঝুপি ম্যাসাকার এবং খবির চাচার মৃত্যু লড়াই, মাঠপাড়ার নজিমুদ্দিন গ্রাম ডাক্তারকে দিয়ে পাক বাহিনীর গোলাবারুদ বহন, এসব ঘটনা গুলো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।তাই বীরের মতই বাঁচার সিদ্ধান্ত নিলাম। সম্ভবত এপ্রিলের শেষ দিকে কোন এক দিন করমদি গ্রাম থেকে আমরা কয়েকজন রওয়ানা দিলাম পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার শিকারপুরের উদ্দেশে। আমাদের সাথে কে কে ছিল, নামগুলো স্পষ্ট মনে নেই। তবে ৮/১০ জন হয়তো হবে।

আমাদের গ্রাম থেকে শিকারপুরে যেতে হলে পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেল ছাড়া কোন যানবাহন ছিলনা। যেহেতু আমরা খুব শীঘ্রই ফিরে আসবনা তাই সাইকেলে যাওয়াটা যুক্তিসঙ্গত নয়। আমরা কাজিপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে মাথাভাঙ্গা নদির কিনার ঘেঁসে হাঁটতে থাকলাম। নদীর পাড়ে যে দৃশ্য দেখলাম, মনে হলে এখনও শরীর শিহরিয়ে ওঠে। নদীর কিনারে বালু মাটি, হাত দিয়েই গর্ত করা যায়। কোন কোন জাইগায় বালুর নিচ থেকে পানি গড়িয়ে আসছে। আবার কোন কোন জায়গায় লাল রংগের কি যেন বের হয়ে আসছে। পরে জানতে পেলাম, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পায়ে হেঁটে ভারতে পাড়ি দিয়েছে এই পথে। বৃদ্ধ মা-বাবা, দাদা-দাদিকে তো আর বাড়িতে রেখে আসতে পারে না। তাদেরকে পিঠে করে, বাঁশের খাটিয়া করে সুদুর রাস্তা পাড়ি দেওয়ার অপচেষ্টা। পেটে নাই ভাত, রাতে নাই ঘুম, প্রতি পদে পদে বিপদ। এখানে বলে রাখি আমাদের মতন ছেলেরাও কিন্ত তাদের জন্য আরেক হায়েনা ছিল, যদিও মুষ্টিমেয়। আমারই গ্রামে আমারই চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটেছে। “এই বুড়ি তোর ঝোলাই কি আছে, বের কর”। অপেক্ষা না করে নিজেই বুড়ির ঝোলা খোলা শুরু হয়ে গেল এক টুকরো সোনার গহনার জন্য। ঝোলার মধ্যে কিছু না পেয়ে উল্টো বুড়িকেই গালিগালাজ। অপরাধটি যেন ওই বুড়ির, জামাই বাবুর জন্য কোন গহনাগাটি না নিয়ে আসার জন্য। আর সাথে যুবতি মেয়ে থাকলে কিযে অত্যাচার সেটা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আমরা মুসলমানিত্তের যথাযথ পরিচয় দিয়েছি অন্যের বিপদের দিনে।

ফিরে যাই নদীর পাড়ে। বৃদ্ধ লোকগুলোকে কাঁধে করে বইতে বইতে এক সময় শক্তিশালী লোকগুলোও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বৃদ্ধ লোকগুলো আরো ঝিমিয়ে যায়। তখনই আসে চরম সত্যটা। বৃদ্ধের জন্য কি নিজেও বলিদান হয়ে যাব? আমারও তো বউ-বাচ্চা আছে, তাদেরকে তো বাঁচাতে হবে! তাই শেষমেশ আপনে বাঁচলে বাপের নামই মোক্ষম হয়ে আসে। রণক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, যার বাঁচার সম্ভাবনা আছে তাকে আগে উদ্ধার কর। তাই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। বৃদ্ধ অথবা বাঁচার সম্ভাবনা যাদের ক্ষীণ, তাদেরকে নদীতে ভাসিয়ে দাও, অথবা নদীর পাড়ে নরম মাটি সরিয়ে মখমলের বিছানাই চিরনিদ্রায় আশ্রয় দিয়ে দাও। আমরা নদীর পাড়ে এমনটিই দেখলা্ম। লাল রঙ্গের তরল যে জিনিষটা মাটির নীচ থেকে বের হয়ে আসছিল সেটা অন্য কিছুই না, সদ্য মাটির নীচে চাপা দেওয়া ব্যাক্তির শরীর থেকে বের হয়ে আসা পানির সাথে মিশে থাকা রক্ত। আবার দেখলাম নদী দিয়ে কিছু লাশ ভেসে যাচ্ছে। কারো কারো শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে, কারো শরীর অক্ষত। তবে কোনটিই স্পষ্টভাবে দেখা সম্ভব হয় নাই। একদিকে ভীষণ গন্ধ অপরদিকে লাশ দেখার জন্য মানসিকভাবে অপ্রস্তুতু।

এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে শিকারপুর পৌছালাম। সেখানে এক ভিন্ন দৃশ্য। রাস্তার দুই পাশে তিনটা জিনিষের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। যত্র তত্র মানুষের মল, বমি অথবা মৃত্যুর সাথে লড়ছে এমন মানুষ। আমরা রুমাল দিয়ে নাক মুখ ঢেকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। পথিমধ্যে দেখলাম একটি ছোট ঘরে একজন বৃদ্ধ মানুষের লাশ, আর তার পাশে বসে আছে একটি শিশু। জানিনা দুজনের কি সম্পর্ক। এমন হতে পারে আদৌ কোন সম্পর্ক নাই , আবার হতে পারে সম্পর্ক আছে, কিন্তু দুজনই পরিত্যাক্ত।

শিকারপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটো ক্যাম্প ছিলো  গেরিলা ক্যাম্প এবং এ্যাকশান ক্যাম্প। একটি ছিল শিকারপুর হাইস্কুলের পূর্ব পাশে এবং অপরটি ছিলো উত্তর পাশে। আর শরনার্থী শিবির ছিলো শিকারপুর হাইস্কুলের বেশ দূরে। আমরা সম্ভবত এ্যাকশান ক্যাম্পে গেলাম। সেখানে দেখা হল ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত জনাব আ. ফ. ম. আব্দুল্লাহর সাথে। তিনি করমদি হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক জনাব ইদ্রিসের ভগ্নিপতির ছোট ভাই। জনাব আব্দুল্লাহ তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করেন। তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার, দৌলতপুর উপজেলার, ফিলিপনগর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে। পরবর্তীতে তিনি কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। (তথ্য সংগ্রহে জনাব সেলিম তোহা, কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর এবং ট্রেজারার (

জনাব আব্দুল্লাহ আমাদেরকে ক্যাম্পে ভর্তি করতে রাজী হলেন না। তাঁর যুক্তি হল আমরা বর্ডারের মানুষ, বাড়িঘর আছে, খাওয়া দাওয়ার খুব বেশী অসুবিধা নাই। কিন্তু যারা ফরিদপুর বা যশোর থেকে আসছে তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে। উনার উত্তর  যুক্তিসংগত ভেবে আমরা গ্রামে ফিরে এলাম।

আজ এখানেই শেষ

mkstoryat2020




coppy from fb id

No comments

Powered by Blogger.