স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৭

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৭ 

উত্তর প্রদেশের দেরাদুনের পথে
     এবার মিলিটারি ক্যাম্পকে বিদায় দেওয়ার পালা। আমরা বিছানা পত্র ভাঁজ করে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলাম। বেলা ১১ টার দিকে বাসে করে রওয়ানা দিলাম। গন্তব্যস্থল তখনো জানিনা। মনে হয় ঘণ্টা খানিক পর আমাদেরকে একটা বিমানবন্দরে নিয়ে এসে বাস থেকে নামার নির্দেশ দেওয়া হল। বাস থেকে নেমে একটা ঘরে উঠলাম, যাত্রীদের ওয়েটিং রুম। কিছু সময় পর একটা উড়োজাহাজ অবতরন করলো। ইতিমধ্যে মুশল ধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আর সেই বৃষ্টির মধ্যেই আমাদেরকে প্লেনে উঠতে বলা হল। উপরে শেডও নাই, সাথে ছাতাও নাই। আমরা শেয়াল ভেজা হয়ে প্লেনে উঠলাম। প্লেনটি ছিল মানুষ বহন করার জন্য নয়, কারগো (মাল বহন করার জন্য)। পরবর্তীতে শুনেছিলাম প্লেনটি ভারত সরকারের নয়, সোভিয়েত (USSR) সরকারের। ওই প্লেনে করেই সোভিয়েত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যুদ্ধাস্ত্র এবং খাদ্যদ্রব্য প্রেরন করত। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারত এবং সোভিয়েত, উভয় সরকারই সরাসরি সহযোগিতা করেছে। যেহেতু মালবাহী প্লেন, তাই প্লেনের মধ্যে বিকট শব্দ এবং প্রচুর গরম। আমরা ক্যাম্প থেকে বের হবার পূর্বেই করিমপুর থেকে নিয়ে আসা খাকি ড্রেস পরতে বলা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য পোশাকের চেয়ে খাকি পোশাক একটু মোটা হয়ে থাকে। তারপরও আমাদের পরনের কাপড় পরনেই শুকাতে খুব বেশী সময় লাগলো না।
  
আমরা সন্ধ্যার কিছু পরে উত্তর প্রদেশের একটা মিলিটারি বিমানবন্দরে নামলাম। নামলাম বটে, কিন্তু কেউ কারোর কথা শুনতে পাইনা। আমাদের কান যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। আসলে বিমান উঠানামার সময় বাতাসের চাপে এমনটি হয়ে থাকে। যতই জোরে কথা বলিনা কেন, মনে হয় আমার কথা আমারই কানে ফিরে আসছে। বিমান বন্দরে কোন আলো নাই। বিমানের হেডলাইট অন করে রাখা হয়েছে। প্লেন অবতরণ করার পূর্বেই আমাদের জন্য খাবার নিয়ে রাখা হয়েছিল। প্লেনের লাইটে রানওয়েতে বসে আমরা ডিনার শেষ করলাম। রানওয়ের দুপাশে ঘন ঘাস, আর ঘাসের মধ্যে ছোট ছোট তাঁবু টাঙ্গানো হয়েছে। তোষকের পরিবর্তে ঘাসের মখমল। তাঁবুর ভিতরে মেঝেতে বিছানোর জন্য একটা মোটা পলিথিন আর গায়ে দেওয়ার জন্য একটা চাদর রাখা হয়েছে। ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে ডেকে উঠানো হল। টয়লেটের কোন ব্যাবস্থা নাই। যে যেভাবে পার সেরে লও। সকালের নাশতা খেলাম, দুপুরের জন্য পরোটা এবং ডিম ভাজি সাথে দিয়ে দিল। আমরা এবার মিলিটারি ট্রাকে উঠলাম। শহর পাড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ের মধ্যে চলা শুরু হল। জীবনে এই প্রথম পাহাড় দেখা। আঁকাবাঁকা রাস্তা। গাড়ী চলছে রাজপুত্রের মত হেলেদুলে। একটা গান মনে পড়ে গেল (ঢেকি নাচে আমিও নাচি হেলিয়া দোলিয়া(।  রাস্তার একদিকে উঁচু পাহাড়, অপর দিকে কয়েকশ মিটার নিচু খাদ। ড্রাইভার একটু বেসামাল হলেই এতগুলো জীবন হিন্দু মুসলমান একসাথে খোদ জান্নাতে। 
 মাঝপথে ট্রাকটি থেমে গেল, আমাদেরকে নামতে বলা হল। সামনে পাহাড় ধ্বস। নেমে দেখলাম পাহাড় ধসের কাছে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে লোকজনকে নিরাপদে পার করার জন্য। স্কুলে পড়ার সময় আমাদের মৌলভি সার বলেছিলেন, পাথরেরও প্রান আছে, তারাও কাঁদে। এবং তাদের চোখের পানি একত্রিত হয়ে নদী তৈরি হয়। সেটাই বাস্তবে দেখলাম। পাথরের বুক ফেটে পানি বের হয়ে আসছে এবং নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। তৈরি করছে ঝর্না। পাথরের উপর পানিগুলো যেন আছড়ে পড়ছে। কি সাংঘাতিক আড়ি একে অপরের সাথে। বিকট শব্দ করে দ্রুত নেমে যাচ্ছে পানির বাচ্চাগুলো। বাচ্চা বলাটাই হইত সঙ্গত, কারন ওদের জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। যেখানে পাহাড় ধ্বস হয়েছে , সেখানে রাস্তার উপর ছোট ছোট পাথর পড়ে আছে। আমাদেরকে খুব দ্রুত রাস্তা পাড়ি দিতে বলা হল। যেকোন সময় উপর থেকে বড় পাথরটি নেমে আসতে পারে। একেকটা পাথরের ওজন কয়েক টন। তাছাড়া উপর থেকে নেমে আসা পানিতে রাস্তার পাথর মাটি গুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে। হঠাৎ করে রাস্তাও ধ্বসে যেতে পারে। আমরা নির্দেশ মোতাবেক রাস্তা পাড়ি দিয়ে অপর দিকে অপেক্ষা করছিল একটা ট্রাকে চেপে বসলাম। ট্রাকটি তার  ইচ্ছা মোতাবেক আবারো চলতে লাগল। আমরা পাহাড়ি রাস্তায় চলতে অভ্যস্ত নই। আঁকাবাঁকা রাস্তা, তদুপরি ঝিকুনি, আমাদের অশিকাংশই বমি করে ফেলল। কেউ কেই ট্রাকের মেঝেতেই সে কাজটি সম্পন্ন করলো। ট্রাকে বসার কোন স্থান নাই। তদুপরি মানুষের বমি ভীষণ গন্ধ। আবার কেউ কেউ বমি দেখলেই বমি করে ফেলে। এযেন বমিরই মেলা। ট্রাকের ছাউনির  রড ধরে দাঁড়িয়ে। এভাবেই সন্ধ্যার কিছু আগে মিলিটারি ট্রেনিং সেন্টারে পৌছালাম। স্থানটি হিমালয় পাহাড় কুঞ্জের কাছাকাছি। সমতল ভুমি থেকে অনেক উপরে। সঠিক উচ্চতা বলতে পারব না। আমরা সাধারণত আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ দেখি, কিন্তু এখানে উল্টা নীচের দিকে তাকিয়ে মেঘ দেখা লাগে।  

আমাদেরকে বারাকে থাকার জায়গা দেওয়া হল। ঘরের জানালা খুলে রাখা নিষেধ, কারন ঘরের মধ্যে মেঘ ঢুকে যেয়ে কাপড় চোপড় সব ভিজিয়ে দিতে পারে। বারাক জীবনের নিয়ম কানুন সম্পর্কে লেকচার শুনলাম। প্রতিদিনের রুটিন সম্পর্কেও বলা হল। তারপর ডাইনিং রুমে গেলাম রাত্রের খাবার খাওয়ার জন্য । এভাবেই দিনটা কেটে গেল।
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৭ our karamdi village
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৭ our karamdi village 


২রা মে, ২০২০ 

আজ এখানেই শেষ

Coppy from FB ID

No comments

Powered by Blogger.