স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৬

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৬     

করিমপুর থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি। সত্যিকারে প্রস্তুতি বলতে তো তেমন কিছু নেই। কাপড় চোপড় সবই থাকে ছোট্ট একটা সুটকেসে। আমরা দুপুরের একটু পরে (সময়ের এদিক ওদিক হতে পারে) বাসে করে রওয়ানা দিলাম প্রথমে কৃষ্ণনগর, সেখান থেকে ট্রেনে কোলকাতা। আমরা যখন শিয়ালদহ ষ্টেশনে পৌছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ভবানিপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারের দুতাবাসে। কে যে আমাদের টীম লিডার ছিল, তার নাম ও মনে নাই, আবার চেহারাও মনে পড়ছে না। 

এখানে একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। হঠাৎ করে বাংলাদেশের দুতাবাস কোথা থেকে এলো? কোলকাতায় পাকিস্তানের কন্সুলার অফিস ছিল এবং সেখানকার ডেপুটি কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন জনাব এম হোসেন আলী। তিনিও তৌফিক এলাহির মতই নিমকহারামি করলেন, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যেয়ে। তিনি ১৮ই এপ্রিল (১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামে বাংলাদেশ সরকারের জন্ম এবং অভিষেক) অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন এবং আনুগত্যতা প্রকাশ করেন। তাঁর সাথে ৭০ জন বাঙালী কর্মচারী যোগ দেন। একজন সরকারী কর্মচারীর জন্য এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খূব সহজ নয়। এটা ছিল বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিরাট শক্তি। তখন থেকে ভারত সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অনেক কাজই এখান থেকে পরিচালিত হতো। আর আমরা প্রথমেই সেই দূতাবাসে যেয়ে হাজির হই। আমাদেরকে কিছু ইন্ডিয়ান মুদ্রা দেওয়া হয় রাত্রের খাবারের জন্য। কোলকাতা আমাদের জন্য নতুন জায়গা, কোথাই কি আছে কিছুই জানি না। অনেক রাত হয়ে গেছে, শেষে অল্প দামের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। সেখানেও দ্বিতীয় বারের মত কালচারাল শক। কেন যেন দোকানদার বুঝে নিয়েছিল আমরা বাঙ্গাল এবং মুসলিম। পশ্চিম বাংলার লোকজন কেন জানিনা আমাদেরকে সেনামেই জানে। খাবার এলো পদ্মপাতায়, পানি ঢেলে দেওয়া হল অনেক উঁচু করে যাতে গ্লাসের সাথে জগের স্পর্শ না করে। এখনকার মত ওয়ান টাইম গ্লাস থাকলে হয়তো কাঁচের গ্লাসের পরিবর্তে সেটাই আসতো। খেয়ে দেয়ে আবারো দূতাবাসে। সেখান থেকে ঝোলাঝম্প বগল দাবা করে শিয়ালদহ ষ্টেশনে। ভোর বেলায় ট্রেন, ততক্ষন প্লাটফরমেই আমাদের অবস্থান। গামছাটা বিছিয়ে সুটকেসটা বালিশ করে গভীর নিদ্রা। সকাল বেলার কাজটা সেরে নেওয়া হল প্লাটফর্মের শেষ মাথায়, কারোর দিকে না তাকিয়ে। 
ট্রেনে উঠলাম। দুরপাল্লার ট্রেন। এখনকার মত রিজার্ভ সীটের ব্যাবস্থা নাই। আর ব্যাবস্থা থাকলেও আমাদের জন্য হয়তো ছিলনা। দীর্ঘ পথের অনেক খানিই দাঁড়িয়ে। রাস্তায় একজন দেখিয়ে দিল ওইটা হাওড়া ব্রিজ, ওই দিকে শান্তিনিকেতন,  অনেকদুর পাড়ি দেওয়ার পর ওইটা ফারাক্কা বাঁধ। ইতিমধ্যে ট্রেনে দেড় দিন পাড়ি দিয়েছি। কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানিনা। মাঝে একবার ট্রেন পরিবর্তন। তারপর গন্তব্যস্থল। ষ্টেশনে নামার পর দেখলাম কয়েকটা বাস অপেক্ষা করছে। আমরা সেসব বাসে উঠে পড়লাম এবং নামলাম একটা মিলিটারি ক্যাম্পে। অনেক বড় বড় তাঁবু। সেখানেই আমাদের থাকার ব্যাবস্থা। পাশ দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে, খুব গভীর নয়, কিন্তু ভীষণ স্রোত। একটু বেখেয়াল করলেই ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। হয়তো নদীর উৎপত্তিস্থল বেশী দূরে নয়। ঝরনার পানি খুব দ্রুত বয়ে যায় এবং ঠাণ্ডা হয়। পরে শুনেছিলাম স্থানটি পশ্চিম দিনাজপুরের কোন একটা জায়গা। 

দুই একদিন পর পরই জুনিয়ার ছাত্র নেতারা এখানে আসতো এবং আমাদের সাথে যুদ্ধ পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কথা বলতো। সেসব নেতাদের নাম ধাম ভুলে গেছি। এখানে আমাদেরকে অনেক সিগারেট দেওয়া হতো। নেতারাও মাঝে মাঝে সেসব সিগারেটের অংশ নিত। আমি ধূমপান করিনা, কাজেই আমি সিগারেট নিতে চাইতাম না। অনেকে আমার অংশটা নিতে চাইত। আমার মনে সর্বদা প্রস্ন জাগত, কেন আমাদেরকে এত সিগারেট দেওয়া হয়। আসলে এটাও হল একধরনের মোটিভেশন পদ্ধতি, ভুলিয়ে রাখা, আমরা যেন হোমসিক অনুভব না করি। 

এখানে আমরা এক সপ্তাহের একটু বেশী দিন কাটালাম। কোন ট্রেনিং নয়, এমনকি শারীরিক ব্যায়ামও নয়। শুধু খাওয়া আর ঘুম। কিছুটা অলস জীবন যাপন। আমরা নেতাদেরকে সর্বদা জিজ্ঞাসা করতাম, আর কতদিন? তারাও সঠিক কোন উত্তর দিতে পারতনা। অনেক অপেক্ষার পর এলো আমাদের আবারো স্থান পরিবর্তনের পালা। 

mkstoryat2020
 আজ এখানেই শেষ
মে ১, ২০২০
Coppy from FB ID

No comments

Powered by Blogger.