স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৮
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৮
শুরু হল মুক্তিযোদ্ধা তৈরির প্রশিক্ষণ
আগেই বলেছি, আমরা সাধারন মুক্তিযোদ্ধা নই। আমরা মুজিব বাহিনীর যোদ্ধা। পার্থক্যটা কি? সাধারন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যুদ্ধের জন্য তৈরি করা হয়। যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার পদ্ধতিই মুল বিষয়। কিন্তু এ ধরনের মুক্তিযোদ্ধাগণ সরাসরি যুদ্ধ করবে সেটাও আশা করা হয় নাই। এরা হচ্ছে গেরিলা ফাইটার। যুদ্ধের কৌশলও ভিন্ন। hit and run হচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের মূলনীতি। নিজে বেঁচে অপরকে কিভাবে আঘাত করা যায়। আঘাত করে সেখানে অবস্থান করা বিপদজনক। আঘাত করেই যত দ্রুত সেখান থেকে বিদায় নিতে হবে। সংগঠিত বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অপরকে পরাজিত করা খুব সহজ নয়। আবার মুক্তিযোদ্ধাগণ সব ক্ষেত্রে সংগঠিতও নয়। ট্রেনিংয়ের বিষয় বস্তুও খুব সাধারণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাইফেল, এস এল আর এবং হ্যান্ড গ্রেনেড। কোন কোন জায়গাই এল এম জির ট্রেনিং করানো হয়েছে। এদিয়ে বর্তমান যুগে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়া নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছই নয়। সংগঠিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে জিতে আসা মোটেই সম্ভব নয়, আমরা তর্কের খাতিরে যাই-ই বলিনা কেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সরাসরি যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল ইপিআর(East Pakistan Rifles)থেকে বেরিয়ে আসা সদস্যগণ। আর ছিল পিছন থেকে ভারত সরকারের সশস্ত্র সহযোগিতা। সংগঠিত বাহিনীর সদস্যগন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছিয়ে গেলে সেটি হচ্ছে অপরাধ।
মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং কারিকুলাম দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হল নিজকে বাঁচানোর জন্য মিনিমাম যুদ্ধাস্ত্রের প্রশিক্ষণ। এর ভিতরে ছিল রাইফেল, এস এল আর, হ্যান্ডগ্রেনেড, সেই সাথে ছোট খাট ব্রিজ ভাঙ্গার ডেটোনেটর ব্যবহারের কৌশল। অপরটি হল মটিভেশনাল ট্রেনিং। আমাদের সময়ের সিংহভাগ কেটেছে ক্লাসরুমে। সেখানে রাজনৈতিক ব্রেনওয়াস। কেন এই যুদ্ধ, এর ভবিষ্যৎ, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি। যুদ্ধের সময় সাধারন জনগনের মানসিক অবস্থার পরিবর্তনকে কিভাবে ঠেকিয়ে রাখা যায়, এটাই ছিল মুক্ষবিষয়। সাধারণত যুদ্ধ দীর্ঘায়ীত হলে জনগণ শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ অবলম্বন করে থাকে। এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে তার পূর্ব প্রস্তুতি। সমস্ত ক্লাস গুলো ইংরাজি ভাষায় হতো, অবশ্য কিছু লেকচার হিন্দিতেও নেওয়া হতো। একবার একজন বাঙ্গালী শিক্ষকও পেয়েছিলাম। তিনি ছিলেন পশ্চিম বাংলার মানুষ।
ক্লাসরুমটি কেমন ছিল একটু দেখে নিই। বাহির থেকে খুব চকচকে, কোথাও কোন দাগ নেই। আমরা ভেবে ছিলাম ভিতরটা হয়তো তেমনই সুন্দর হবে। কিন্তু ভিতরে ঢুকে ঠিক উল্টো চেহারা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কোথাও একটা বেঞ্চ বা চেয়ার নেই। ফ্লোরে ১০ ইঞ্ছি পুরো বালি, তার ভিতর পাথর গুঁড়ি। সেখানেই বসে ক্লাস করতে হবে। আমরা কেউ কেউ রুমাল বিছানোর অপচেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। আমাদেরকে বলা হল ইন্ডিয়ান সরকারের চেয়ার কেনার অর্থের অভাব নেই, তবু কেন এমনটি করা হয়েছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে হয়তো ময়লার মধ্যে বসে খেতেও হতে পারে। অথবা ময়লার ভিতর যুদ্ধ করতে হতে পারে। তখন যদি ইতস্তত কর, হয়তো ততক্ষনে তোমার জীবনটাই শেষ হয়ে যেতে পারে। মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, আশ্চর্যের কিছু নেই। তাই এখন থেকেই সব ধরনের মানসিক প্রস্তুতি।
আমাদের শরীর তৈরির জন্য পাহাড়ে উঠার ট্রেনিংও হত। মাঝে মাঝে পাহাড়ে উঠতাম, এটা খুব সহজ নয়। প্রচুর শারীরিক শক্তি এবং অভ্যাসের প্রয়োজন। তাছাড়া সব চেয়ে ভয়ের ব্যাপার ছিল দলচ্যুত হয়ে যাওয়ার। একবার হারিয়ে গেলে পাহাড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখন কার মত মোবাইল ফোন তো আর ছিলনা। তাই সব সময় দলের সাথে থাকতে হতো। দুপুরে লাঞ্চ করে খেয়াল রাখতে হত কোথাও যেন খাবারের উচ্ছিষ্ট বা পানি পড়ে না থাকে। শ্ত্রু পক্ষ এগুলো দেখে অনুমান করে নিতে পারে কত জন ব্যক্তি এসেছিল, কত সময় পূর্বে এসেছিল ইত্যাদি। আর এসব ক্লু গুলোই নিজেদের বিপদ ডেকে নিয়ে আসে। আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটা হল কখনই সকলে একত্রিত না বসা। যদি শত্রু পক্ষ আক্রমণ করে, তবে সকলেই এক সাথে মারা যাবে। এগূলো যে কোন নিরাপত্তা বাহিনীর মূলমন্ত্র। তাই আমরা ৪/৫ জনের গ্রুপ করে বসে খাওয়া দাওয়া করতাম। খাওয়া শেষে কোথাও কোন উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে কিনা চেক করা।
রাত্রি বেলায়ও ট্রেনিং হয়েছে। পাহাড়ের রাত্রি ভীষণ অন্ধকার। ৫ ফূট দূরে কী আছে চেনা মুশকিল। আমরা সামনের ব্যক্তির পিছনের বেল্ট ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হতাম। পাহাড়ি রাস্তার একপাশে উঁচু ঢালু, যে কোন সময় উপর থেকে পাথর গড়িয়ে আসতে পারে। আবার অপর দিকে কয়েক শ ফুট গর্ত। এদিক ওদিক হলে, বা বেল্ট থেকে হাত সরে গেলে, তার পরিনাম যে কি তা অনুমেয়। তবে আমরা ভাগ্যবান যে আমাদের কারোরই তেমন কোন সমস্যা হয় নাই।
৩রা মে, ২০২০
আজ এখানেই শেষ
coppy from Fb Id
শুরু হল মুক্তিযোদ্ধা তৈরির প্রশিক্ষণ
আগেই বলেছি, আমরা সাধারন মুক্তিযোদ্ধা নই। আমরা মুজিব বাহিনীর যোদ্ধা। পার্থক্যটা কি? সাধারন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যুদ্ধের জন্য তৈরি করা হয়। যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার পদ্ধতিই মুল বিষয়। কিন্তু এ ধরনের মুক্তিযোদ্ধাগণ সরাসরি যুদ্ধ করবে সেটাও আশা করা হয় নাই। এরা হচ্ছে গেরিলা ফাইটার। যুদ্ধের কৌশলও ভিন্ন। hit and run হচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের মূলনীতি। নিজে বেঁচে অপরকে কিভাবে আঘাত করা যায়। আঘাত করে সেখানে অবস্থান করা বিপদজনক। আঘাত করেই যত দ্রুত সেখান থেকে বিদায় নিতে হবে। সংগঠিত বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অপরকে পরাজিত করা খুব সহজ নয়। আবার মুক্তিযোদ্ধাগণ সব ক্ষেত্রে সংগঠিতও নয়। ট্রেনিংয়ের বিষয় বস্তুও খুব সাধারণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাইফেল, এস এল আর এবং হ্যান্ড গ্রেনেড। কোন কোন জায়গাই এল এম জির ট্রেনিং করানো হয়েছে। এদিয়ে বর্তমান যুগে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়া নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছই নয়। সংগঠিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে জিতে আসা মোটেই সম্ভব নয়, আমরা তর্কের খাতিরে যাই-ই বলিনা কেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সরাসরি যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল ইপিআর(East Pakistan Rifles)থেকে বেরিয়ে আসা সদস্যগণ। আর ছিল পিছন থেকে ভারত সরকারের সশস্ত্র সহযোগিতা। সংগঠিত বাহিনীর সদস্যগন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছিয়ে গেলে সেটি হচ্ছে অপরাধ।
মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং কারিকুলাম দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হল নিজকে বাঁচানোর জন্য মিনিমাম যুদ্ধাস্ত্রের প্রশিক্ষণ। এর ভিতরে ছিল রাইফেল, এস এল আর, হ্যান্ডগ্রেনেড, সেই সাথে ছোট খাট ব্রিজ ভাঙ্গার ডেটোনেটর ব্যবহারের কৌশল। অপরটি হল মটিভেশনাল ট্রেনিং। আমাদের সময়ের সিংহভাগ কেটেছে ক্লাসরুমে। সেখানে রাজনৈতিক ব্রেনওয়াস। কেন এই যুদ্ধ, এর ভবিষ্যৎ, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি। যুদ্ধের সময় সাধারন জনগনের মানসিক অবস্থার পরিবর্তনকে কিভাবে ঠেকিয়ে রাখা যায়, এটাই ছিল মুক্ষবিষয়। সাধারণত যুদ্ধ দীর্ঘায়ীত হলে জনগণ শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ অবলম্বন করে থাকে। এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে তার পূর্ব প্রস্তুতি। সমস্ত ক্লাস গুলো ইংরাজি ভাষায় হতো, অবশ্য কিছু লেকচার হিন্দিতেও নেওয়া হতো। একবার একজন বাঙ্গালী শিক্ষকও পেয়েছিলাম। তিনি ছিলেন পশ্চিম বাংলার মানুষ।
ক্লাসরুমটি কেমন ছিল একটু দেখে নিই। বাহির থেকে খুব চকচকে, কোথাও কোন দাগ নেই। আমরা ভেবে ছিলাম ভিতরটা হয়তো তেমনই সুন্দর হবে। কিন্তু ভিতরে ঢুকে ঠিক উল্টো চেহারা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কোথাও একটা বেঞ্চ বা চেয়ার নেই। ফ্লোরে ১০ ইঞ্ছি পুরো বালি, তার ভিতর পাথর গুঁড়ি। সেখানেই বসে ক্লাস করতে হবে। আমরা কেউ কেউ রুমাল বিছানোর অপচেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। আমাদেরকে বলা হল ইন্ডিয়ান সরকারের চেয়ার কেনার অর্থের অভাব নেই, তবু কেন এমনটি করা হয়েছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে হয়তো ময়লার মধ্যে বসে খেতেও হতে পারে। অথবা ময়লার ভিতর যুদ্ধ করতে হতে পারে। তখন যদি ইতস্তত কর, হয়তো ততক্ষনে তোমার জীবনটাই শেষ হয়ে যেতে পারে। মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, আশ্চর্যের কিছু নেই। তাই এখন থেকেই সব ধরনের মানসিক প্রস্তুতি।
আমাদের শরীর তৈরির জন্য পাহাড়ে উঠার ট্রেনিংও হত। মাঝে মাঝে পাহাড়ে উঠতাম, এটা খুব সহজ নয়। প্রচুর শারীরিক শক্তি এবং অভ্যাসের প্রয়োজন। তাছাড়া সব চেয়ে ভয়ের ব্যাপার ছিল দলচ্যুত হয়ে যাওয়ার। একবার হারিয়ে গেলে পাহাড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখন কার মত মোবাইল ফোন তো আর ছিলনা। তাই সব সময় দলের সাথে থাকতে হতো। দুপুরে লাঞ্চ করে খেয়াল রাখতে হত কোথাও যেন খাবারের উচ্ছিষ্ট বা পানি পড়ে না থাকে। শ্ত্রু পক্ষ এগুলো দেখে অনুমান করে নিতে পারে কত জন ব্যক্তি এসেছিল, কত সময় পূর্বে এসেছিল ইত্যাদি। আর এসব ক্লু গুলোই নিজেদের বিপদ ডেকে নিয়ে আসে। আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটা হল কখনই সকলে একত্রিত না বসা। যদি শত্রু পক্ষ আক্রমণ করে, তবে সকলেই এক সাথে মারা যাবে। এগূলো যে কোন নিরাপত্তা বাহিনীর মূলমন্ত্র। তাই আমরা ৪/৫ জনের গ্রুপ করে বসে খাওয়া দাওয়া করতাম। খাওয়া শেষে কোথাও কোন উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে কিনা চেক করা।
রাত্রি বেলায়ও ট্রেনিং হয়েছে। পাহাড়ের রাত্রি ভীষণ অন্ধকার। ৫ ফূট দূরে কী আছে চেনা মুশকিল। আমরা সামনের ব্যক্তির পিছনের বেল্ট ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হতাম। পাহাড়ি রাস্তার একপাশে উঁচু ঢালু, যে কোন সময় উপর থেকে পাথর গড়িয়ে আসতে পারে। আবার অপর দিকে কয়েক শ ফুট গর্ত। এদিক ওদিক হলে, বা বেল্ট থেকে হাত সরে গেলে, তার পরিনাম যে কি তা অনুমেয়। তবে আমরা ভাগ্যবান যে আমাদের কারোরই তেমন কোন সমস্যা হয় নাই।
karamdi-2020 |
৩রা মে, ২০২০
আজ এখানেই শেষ
coppy from Fb Id
thanks
ReplyDelete