Some memories of independence 40 Change in the social structure of post-war Karamadi village
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৪০
যুদ্ধোত্তর করমদি গ্রামের সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো বা লিডারশিপ সিস্টেম বা সাধারণ জনগণের চিন্তা চেতনার উপর স্বাধীনতা যুদ্ধ কেমন প্রভাব ফেলেছে, এ বিষয়ে একটু টাচ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। যুদ্ধ মানেই হল সব কিছু ওলট পালট। আর এই ওলট পালটকে আমরা দুটো ভাগে ভাগ করে দেখতে পারি। প্রথমটি হল ভগ্নুর এবং দৃষ্টিযোগ্য কাঠামো (hard structure) যেমন বাড়িঘর, রাস্তা, ব্রিজ ইত্যাদি ভেঙ্গে নতুন কাঠামো তৈরি হয়। এই পরিবর্তনটি হয় খুবই দ্রুত। দ্বিতীয়টি হল কালচারাল পরিবর্তন (soft structure), যেমন ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, বংশের সাথে বংশের, সমাজের সাথে সমাজের, ধর্মীয় চিন্তা ভাবনা ইত্যাদি। সেই সাথে পরিবর্তন আসে মানুষের সম্মান বোধও, সেটা নিজের প্রতি এবং অন্যের প্রতিও। এই পরিবর্তন তাৎক্ষনিক বোধগম্য না হলেও সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে লক্ষণীয় হয়ে আমাদের চোখে ধরা পড়ে।
এবার ফিরে আসি আমার জন্মভূমি করমদি গ্রামে। গ্রামটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৪ কিলোমিটার লম্বা। অনেক পুরাতন গ্রাম। কবে এখানে জনবসতি শুরু হয়েছিল তার ইতিহাস আমার জানা নাই। মাঝখান দিয়ে লম্বা একটা রাস্তা বয়ে গেছে, আর রাস্তার দুই পাশ দিয়ে লোকজনের বসবাস। অবশ্য এই বড় রাস্তা থেকে কয়েকটি সরু রাস্তা বের হয়ে গেছে ভিতরের দিকে, সেখানে জন্ম নিয়েছে ঘন বসতি কয়েকটি পাড়া। গ্রামের বর্তমান জনসংখ্যা ১০ হাজারের কাছাকাছী। গ্রামের মধ্যস্থলে ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় বিত্তবান লোকদের সহযোগিতায় তৈরি হয়েছিল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যেখানে আমার বাবাও লেখাপড়া করেছে। আমার বড় ভাইয়েরা, এমনকি আমরাও সেই স্কুলেই। সামনে ছিল একটি বিরাট বট গাছ। বর্তমানে যেখানে হাট বসে, সেখানে ছিল ব্রিটিশদের কাচারি ঘর, তার পাশে ছিল একটি সরকারি ডিসপেনসারি। প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ধীরে ধীরে পাতা গজিয়ে হাই স্কুলে রূপ নেই। প্রথম এস এস সি পরীক্ষা হয় ১৯৬৭ সালে, জাহিদ হাসানদের ব্যাচ, আর আমরা হলাম তৃতীয় ব্যাচ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পূর্বে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়। সম্ভবত ১২ বীঘা জমির উপর, এত বিশাল জমির উপর প্রাথমিক বিদ্যালয় গাংণী থানায় আর দ্বিতীয়টি নাই। গ্রামের মানুষের দেওয়া জমি, বিল্ডিং তৈরির টাকা সরকার থেকে, এ যেন ৫০/৫০ অংশগ্রহন। কয়েক বছর পর হাইস্কুলটিও স্থানান্তরিত হল বর্তমান স্থানে। সেখানেও করমদি গ্রামের মানুষের প্রদত্ত জমির উপর। করমদি গ্রামের মানুষের যেন এটাই সংস্কৃতি। স্কুল স্থানান্তর থেকেই এই জায়গাটি গ্রামের মধ্যস্থল হিসাবে রূপ নিতে লাগে, আর সেই প্রসেস এখনও চলমান।
এই লম্বা গ্রামটিতে উল্লেখযোগ্য ৪ জন নেতা ছিলেন। ১। জনাব ঈমাণ আলী শিকদার, ২। জনাব বায়েজ উদ্দিন বিশ্বাস, ৩। জনাব মীর আফজাল হোসেন এবং ৪। জনাব মকবুল হোসেন বিশ্বাস। জনাব ঈমাণ আলী শিকদার এবং জনাব বায়েজ উদ্দিন বিশ্বাস, দুজনই এই গ্রামের ঘর জামাই, শিক্ষিত এবং দীর্ঘদিন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর। বাকী দুজন বংশ পরম্পরাই এই গ্রামের বাসিন্দা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ৪ নেতাদের মধ্যে লুকায়িত ছিল চাপা ক্রোধ। মীর সাহেব ছিলেন খুবই হাসি খুশির মানুষ। করমদি গ্রামের দুটো স্কুলের এমন কোন প্রোগ্রাম ছিল না যেখানে মীর সাহেব নেই, আর এমন কোন প্রতিষ্ঠান নাই যেখানে উনার কোন অবদান নাই। আর মকবুল বিশ্বাস ছিলেন কিছুটা পশ্চিম মূখী, অর্থাৎ করমদি গ্রামের চেয়ে তেঁতুলবাড়িয়ার সাথে বেশী দহরম মহরম।
করমদি গ্রামের এক চতুর্থাংশ মানুষ ছিল হিন্দু ধর্মালোম্বী। আর্থিক দিক থেকেও তুলনামূলক ভাবে শিক্ষিত এবং বিত্তবান। ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পর তারা জমি বা বাড়িঘর বিনিময় করে ওপারে চলে যায়। আর ওপার থেকে কিছু মুসলমান এপারে চলে আসে। শুনেছি কারো কারোর সাথে ছিল অসম বিনিময়। এদেরকে বলা হতো রিফুজি। ঐ পাড়াটীকেও বলা হতো রিফুজি পাড়া। অবশ্য বর্তমানে সরকার পাড়া নামে পরিচিত। কেনই বা এভাবে নাম পরিবর্তন হলে সেটাও জানা নাই। হয়তো একই গ্রামের বাসিন্দা হিসাবে এধরণের শ্রেণিভেদ উচ্ছেদ করার জন্যই নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। বংশ পরম্পরাই যারা এই গ্রামের বাসিন্দা তাদেরকে বলা হতো বসতি। প্রথম থেকেই দেখেছি বসতী এবং রিফুজিদের মধ্যে চাপা হিংসা। বিশেষ করে বহলপাড়া এবং রিফুজি পাড়ার লোকজনের মধ্যে এই হিংসা ছিল একটু বেশী প্রকট।
আবার পেশাগত দিক থেকে কয়েকটি জাতের লোক এই গ্রামে বাস করত। এদের মধ্যে আবার ছিল ঊচূ নিচু শ্রেণী বিন্যাস। এখানে জাতি শব্দটি ব্যবহার করছি এজন্যই যে অনেক সমাজবিজ্ঞানী তাদের বাংলাদেশ এবং ভারতের গবেষণায় এই শব্দটিই ব্যবহার করেছে বলে। মীর বা মোল্লা, মসজিদের ইমামতি ছিল তাদের প্রধান কাজ। হিন্দু পুরোহিতদের সাথে এদের তুলনা করা হত। কারিগর বা তাঁতি, কাপড় বুনিয়ে সংসার চালাত। শাজী, ঘাণী ভাঙ্গিয়ে তেল তৈরি করে বিক্রি করে সংসার চালাত। কাহার বা সর্দার, বিশেষ করে বিয়ের কনে এবং জামাইকে পালকী করে বয়ে দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। সবার নিজ নিজ পেশাগত আইডেন্টিটি বজায় রাখার জন্য তারা একই এলাকায় গোচ্ছাকারে বাস করত এবং এখনও করে। এই ৪ টি জাতের বাইরে বিরাট একটা অংশ আছে যাদের কোন পদবী নাই। এদেরকে কি নামে ডাকা যায়, সে নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত আছে। কেঊ এদেরকে চাষী বলে অভিহিত করে। এরা সব জাতের সাথেই মিশতে পারে। মীর জাতের লোকজন তুলনামুলক ভাবে শিক্ষিত এবং আর্থিক ভাবে সচ্ছল। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল কাহার জাত, তাদের না ছিল শিক্ষা, না ছিল অর্থ। আর এজন্যই তারা সবদিক থেকেই ছিল পিছিয়ে। যাদেরকে আমরা চাষি জাত বলে পরিচয় দিচ্ছি, গ্রামের নেতৃত্ব ছিল তাদেরই হাতে, শিক্ষার দিক থেকেও তারাই অগ্রসর।
হিন্দু জাত প্রথার মতই ছিল করমদি গ্রামের জাত প্রথা। কে উঁচু, আর কে নিচু, এই নিয়ে ছিল ভীষণ দ্বন্দ্ব। যেমন কাহার জাতের কোন বিয়ে বাড়িতে অন্য জাতের লোক অংশ গ্রহন করত না। অবশ্য সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছিল। বহল পাড়ায় একটা কথা প্রচলিত ছিল, চারিদিকে কাহার মধ্যখানে বাহার। অর্থাৎ বাহার নামে অতি সহজ সরল একজন লোক ছিল যে এই সমাজ প্রথা মানত না। কাহারদের বিয়ে বাড়িতে যাওয়া, একসাথে খাওয়া, এগুলো সবই ছিল তার নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু তার বিপরীত অবস্থাও ছিল এই বহল পাড়াতে। কাহার জাতের একজন লোক ম্যাট্রিক পাশ করার পর পাকিস্তান আর্মিতে চাকরী নিয়ে কোয়েটা চলে যায়। সেখানে তারই একজন কলিগের পরিচয়ের মাধ্যমে দৌলতপুর থানার তার বোনকে সে বিয়ে করে, কিন্তু সে যে কাহার জাতের সন্তান, সেই তথ্য গোপন করে। সে যখন সস্ত্রিক করমদিতে আসে, তখন গ্রামের লোকজন তার উপর ভীষণ অত্যাচার করে। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। এর চেয়েও জঘন্য কিছু ঘটেছিল, সেগুলো নাই-ই বা বললাম।
স্বাধীনতার পর এই সমাজ কাঠামোর কি পরিবর্তন হল? ৪ নেতা চিরন্তন ক্ষমতা থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগলো, আর সেই জায়গাটি দখল করতে লাগলো অন্য জাতের লোকজন। নতুন ভাবে লিডারশীপ বা সমাজ কাঠামোর আবির্ভাব হতে শুরু করলো। অবশ্য এর পিছনে সবচেয়ে বেশী ভুমিকা রেখেছে শিক্ষার প্রসারতা। ২০১২ সালে করমদি গ্রামে জাতিভেদ প্রথাকে কেন্দ্র করে একটা সার্ভে করেছিলাম। সেখানে দেখেছি মীর পরিবারের একজন শিক্ষিত মানুষ কাহার জাতের কোন ছেলে বা মেয়ের সাথে নিজের ছেলে মেয়ের বিয়ে দিতে কোন আপত্তি নাই বলে জানাল। আবার চাষি পরিবারের খুব অল্প শিক্ষিত একজন ব্যক্তির মন্তব্য হল ঠিক উল্টা। সে মনে করে সাজিরা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ, তাই তাদের সাথে কোন সম্পর্ক হতে পারে না।
৯০ দশকের পর থেকে এই পরিবর্তন টা আসে খুবই দ্রুত। সেটা শুধুমাত্র আন্তজাতির মধ্যেই নয়, চাষি এবং অন্য জাতির মধ্যেও পরিবর্তনটা লক্ষণীয়। সেজন্যই আমরা দেখলাম ইউনিয়ন পরিষদের মেম্ব্রর পদে খুবই গরীব মানুষ প্রার্থী হয়ে জিতে যাওয়া, নাম সই করতে কষ্ট হয় এমন ব্যক্তিও মেম্বর হল, কাহার জাতের লোক হল ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর, সাজি পরিবারের লোক হল হাই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান। আর এটা সম্ভব হয়েছে পেশাভিত্তিক জাত প্রথার পরিবর্তন আসার কারনে, অর্থাৎ এখন কারিগররা আর কাপড় বুনোয় না, সাজিরা ঘানি ভাঙ্গে না, কাহাররা পালকি বয় না। জাতিভেদ প্রথা নিয়ে সাধারন মানুষের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। জাতি হিসাবে নয়, ব্যক্তি হিসাবে মানুষকে দেখার প্রবনতা বা মানসিকতা তৈরি হয়েছে। সকলেই যে এই পরিবর্তনকে সহজ ভাবে মেনে নিয়েছে, তা নয়। এখনও কিছু লোকের মধ্যে সে আমলের গোঁড়ামি লক্ষ্য করা যায়। আগামি দিনে এই পরিবর্তন আরও দ্রুত হবে আশা করি। জাতিভেদ প্রথা বিলুপ্ত হলেই এই সমাজের সার্বিক উন্নয়ন হবে।
No comments