স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৩৯
মুজিব বাহিনী এবং রক্ষীবাহিনী / স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ
কারা এই মুজিব বাহিনী? এই বিশ্লেষণের পূর্বে একটু বলে নিতে চাই কারা মুক্তিবাহিনী? নিয়মিত বাহিনী অর্থাৎ ই পি আর, পুলিশ বা মিলিটারিতে চাকুরিরত কিছু জোয়ান ২৬শে মার্চের পর মুক্তিযদ্ধে অংশ নেয়। কেউ কেউ সত্যিকারে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, কেউবা আবার ভবিষ্যতে বড় পোস্টটি দখলের আশায়। এরা দেশকে মুক্তির জন্য নয়, বরং নিজের আখেরাত গোটানোর জন্য। আবার একশ্রেনির জোয়ানরা স্বস্ব বাহিনিতেই থেকে যায়। এর পিছনে দুটি কারন ছিল, একটি হল যেহেতু এতদিন পাকিস্তানীদের লবন খেয়েছি, তাই এখন কি করে নিমক হারামি করি? আরেকটি কারন ছিল যদি মুক্তিযোদ্ধারা হেরে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান যথাযথ বহাল থাকে, তখন নিজেদের কি হবে, এমনটি ভেবে।
নিয়মিত বাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সংখ্যা খুব বেশী ছিল না, দশ হাজারের মত। এদের সাথে যোগ দেয় সাধারন ঘরের ছেলেরা, স্বেচ্ছাবরন মুক্তিযোদ্ধা। বয়সের দিক থেকে বিশের এদিক ওদিক, শরীরের রক্ত যেন সর্বদাই টগবগ করে। এদের আবার একটা বিরাট অংশ ছিল অল্প শিক্ষিত এবং আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে। ট্রেনিংয়ের বিষয় বস্তু ছিল খুব সাধারন এবং সেগুলো প্রধানত অস্ত্র ব্যবহারের কৌশলকে কেন্দ্র করে। দেশ ব্যাপি এদের সংখ্যা ছিল আনুমানিক এক লাখের উপর। এরা ছিল মুজিব ভক্ত এবং দেশকে স্বাধীন করে ছাড়ব এমনই প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নিয়মিত বাহিনী থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধা এবং সেচ্ছাবরন মুক্তিযোদ্ধা, উভয়ই মুজিবনগর সরকারের (প্রবাসী সরকার) নেতৃত্তে দায়িত্ব পালন করেছে।
এবার আসি মুজিব বাহিনী নিয়ে। বিশেষ করে প্রবাসী সরকার গঠনের পরে ছাত্র নেতারা বুঝতে পারে তাদেরকে অবহেলা করা হচ্ছে। এর একটা সুস্পষ্ট কারন ছিল, তাজ উদ্দিন সাহেব ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করার জন্য দিল্লী যান। সেখানে ভারতের প্রধান মন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী তাকে জিজ্ঞাসা করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা কে? তাজ উদ্দিন সাহেব হঠাৎ এমন প্রশ্নের সম্মুখিন হবেন আশা করেন নাই। থতমত খেয়ে উত্তর দেন (আমিই প্রধান মন্ত্রির দায়িত্তে আছি) বলে নিজেকে পরিচয় দেন। সাথে সাথে বিষয়টি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হয়ে যায়। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাগন তো বটেই, ছাত্রলীগের নেতাগনও বিরক্ত বোধ করেন। আওয়ামী লীগ এবং ছাত্র লীগের মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম নেয়। শেখ মুজিব বাংলাদেশে ফিরে এলে তাজ উদ্দিন সাহেবকে একটু দূরে রাখার পিছনে সম্ভবত এটা একটা কারন। এসময় ভারতীয় আর্মির উচ্চপদস্থ একজন অফিসার জেনারেল উবান ছাত্র নেতাদেরকে উপদেশ দেয় ভিন্ন একটা বাহিনী তৈরি করার জন্য। কিন্তু এই বাহিনীর সদস্যগন হবে মধ্যবিত্ত পরিবারের, শিক্ষিত, অংক এবং ইংরাজিতে পারদর্শী, অবশ্যই ছাত্র লীগের কর্মী। গাংনি থানার মুজিব বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য গুলো লক্ষ্য করা যায়। এদেরকে অস্ত্রের ট্রেনিংয়ের চেয়ে রাজনৈতিক ট্রেনিং দেওয়া হবে। এই বাহিনীর কমান্ডার হবে শেখ মুজিব, তার অনুপস্থিতিতে শেখ ফজলুল হক মণি কমান্ডারের দায়িত্ব নিবেন। এদেরকে ট্রেনিং করিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হবে, বর্ডার ক্রস করার সাথে সাথেই তারা যেন অস্ত্র গুলোকে পলিথিন দিয়ে জড়িয়ে কোন গোপন জায়গায় রেখে দেয়, এমনটিই নির্দেশ। তার বিনিময়ে মুজিব বাহিনীর কাজ হবে রাজনৈতিক, সাধারন জনগনকে মোটিভেট করা। আমাদের খেত্রেও তাই-ই হয়েছিল। করিমপুর রিক্রুটিং ক্যাম্পে কুষ্টিয়ার ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম আমাদের ইন্টার্ভিউ নিয়েছিলেন এবং প্রশ্নগুলো ছিল ইংরাজিতে। তখনও আমরা বুঝিনাই বা আমাদেরকে বলা হয় নাই আমরা মুজিব বাহিনীর সদস্য হতে যাচ্ছি।
শেখ মুজিব দেশে ফিরে এলেন, প্রধান মন্ত্রির দায়িত্ব নিলেন। সামনে দেখলেন অজস্র সমস্যা। দেশপ্রেম যেন জানালা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। নিয়মিত বাহিনী থেকে যে সমস্ত সেনা সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তারা রাজনৈতিক নেতাদের উপর মাতবরি শুরু করেছে। মনে হচ্ছে আরেকটা ক্ষমতার লড়াই খুব শীঘ্রই শুরু হবে। রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া দেশে এধরনের ঘটনা বিরল নয়। তখনই এক ভারতীয় আর্মি প্রধান স্মরণ করিয়ে দেয়, Don’t put all your eggs in one basket. অর্থাৎ তোমার সমস্ত ডিমগুলো একটা ঝুড়িতে রেখ না। ঝুড়িটা যদি কাত হয়ে যায়, তাহলে সমস্ত ডিমগুলোই ভেঙ্গে যাবে। অতএব ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন জায়গায় রেখে দাও।
এদিকে দেশের আইন শৃঙ্খলার সাংঘাতিক অবনতি ঘটতে থাকে। খুন খারাবি, সন্ত্রাসী, শ্রমিক অসন্তোষ, ধাপ্পাবাজি, অপহরন ইত্যাদি চরম আকারে পরিনত হয়। শুধু তাই-ই নয়, নিজের দলের লোকজন ও মুনাফিকি শুরু করে। সেজন্য ১৯৭২ সালের ৬ই এপ্রিল ১৬ জন, ৯ই এপ্রিল ৭ জন এবং ২২ শে সেপ্টেম্বর ১৯ জন সাংসদকে শেখ মুজিব বহিস্কার করেন। ১৯৭৩ সালে ১৮৯৬ টি হত্যাকাণ্ড, ১৯৭২ ও ৭৩ সালে ৫৪ টি থানা এবং পুলিশ ফাঁড়ি লুট হয়। মেহেরপুরের ট্রেজারি এবং অস্ত্র গুদামঘর লুটও ঐ সংখ্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই অবস্থাকে কিভাবে সামাল দেওয়া যায়, এনিয়ে শেখ মুজিব খুবই উদ্বিগ্ন। ইতিমধ্যে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের নেতাদের চেয়ে বরং ছাত্র নেতাদের দিকে নির্ভরশীল হতে থাকে। তাদেরই পরামর্শে মুজিব বাহিনী থেকে কিছু ব্যাক্তিকে রিক্রুট করে রক্ষী বাহিনী তৈরি করার উদ্যোগ। এদের দায়িত্ব হল স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করা। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১৫০ টি থানায় রক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়। source: আনোয়ার উল আলম রক্ষীবাহিনীর সত্য মিথ্যা 」
প্রথম দিক থেকেই রক্ষী বাহিনীর সদস্যদের একটু ভিন্ন চোখে দেখা হত। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ, চামড়ার বুট, গাড়ী ইত্যাদি ছিল আধুনিক এবং ভিন্ন ধরনের। আমরা দেখেছি সহড়াতলা গ্রামে বিডিআর ক্যাম্পের বর্ডার রক্ষীদের বেশভুশ। শীতের রাত্রে সোয়েটার গায়ে স্যান্ডেল পায়ে ডিউটি। একই দেশের দুই ধরনের সিস্টেম। প্রতিটা থানাতে রক্ষী বাহিনীর একটা করে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। তারা স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শে কাজ শুরু করে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায়, নেতাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তারা ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে ধীরে ধীরে রক্ষী বাহিনীর প্রতি জনগনের আস্থা উঠে যেতে শুরু করে, এমনকি তারা ভয়ের পাত্র হয়ে যায়।
এখানে কয়েকটি এপিসোড উল্লেখ না করলেই নয়। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনলাম গ্রামে রক্ষী বাহিনী এসেছে। করমদি পশ্চিম পাড়ার মীর আব্দুল কাদের (মীর জাহাংগির হোসেনের ভগ্নিপতি), পলাশিপাড়ার হারেজ উদ্দিন (ফড়ুর বাবা) কে রক্ষী বাহিনীরা ধরে নিয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে জানলাম বালিয়াঘাটের একজনকেও ধরে নিয়ে এসেছে। এদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমার জানা নেই। শুধুমাত্র একজন ছাড়া আর কারোর লাশ খুঁজে পাওয়া যায় নাই। আর সেই লাশটিও খলিসাকুন্ডির নিকটে কোন এক নদীর কিনারে ভাসছিল। পরবর্তীতে শুনেছি রক্ষী বাহিনীরা অন্য এক কাদেরকে ধরতে এসেছিল, কিন্তু ভুলবশত মীর আব্দুল কাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এই তিন ব্যক্তির হত্যার জন্য কে দায়ী? তার ছেলেমেয়ে বা স্ত্রী কিভাবে বাকি দিনগুলো কাটিয়েছে, এসংবাদ কি কেউ নিয়েছে?
একদিন সকাল বেলায় বামন্দির আশে পাসের গ্রাম থেকে অনেক লোকজনকে ধরে আনা হয়। তাদের চোখ বাঁধা, হাত দুটোও পিছনে মোড়া দিয়ে বাঁধা। বামন্দি বাজারে তাদেরকে সারি করে শুয়ে রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে আমাদের বড় দুলাভাই বালিয়াঘাটের হাজী মকবুল হোসেন ছিলেন। মানুষ গুলোকে লাইন করে শুয়ে দিয়ে রক্ষী বাহিনীর লোকজন তাদের পিঠের উপর দিয়ে চামড়ার বুট পরে এদিক থেকে ওদিক, এ যেন মানুষ দিয়ে তৈরি সাঁকো পাড়ি দেওয়া। সেই সময় থেকে আমার দুলাভাই কখনই আওয়ামী লীগের নাম শুনতে পারেন না। আমার চাচা শ্বশুর আব্দুস সামাদকেও ধরে নিয়ে এসে গাংনি ক্যাম্পে দীর্ঘদিন আটকিয়ে রেখেছিল। এছাড়া মানুষকে পায়ের সাথে রশি বেঁধে উলটো করে গাছে টাঙ্গিয়ে বেত্রাঘাত, কাপড় দিয়ে মাথা চোখ ঢেকে পানি ঢেলে দেওয়া ইত্যাদি খুব স্বাভাবিক শাস্তি পদ্ধতি ছিল।
আমি একদিন সকালে রাজশাহির উদ্দেশে বের হয়েছি। গ্রামের লোকজন থেকে শুনলাম রক্ষী বাহিনী এসে গ্রাম ঘেরাও করেছে। আমি থমকে গেলাম। একটু বেলা হলে শুনলাম রক্ষী বাহিনীর লোকজন চলে গেছে। তবুও নিরাপত্তার জন্য আতর সর্দারের ঘোড়ার গাড়ির সামনে পিছনে সাদা কাপড় বেঁধে বামন্দি বাস স্ট্যান্ডে গেলাম। সেবারে কোন বিপদ ছাড়াই গন্তব্য স্থলে পৌঁছিয়েছিলাম।
শেখ মুজিব এবং তার অনুসারি ছাত্র নেতাগন যে উদ্দেশ্য নিয়ে রক্ষী বাহিনী তৈরি করেছিলেন, ফিল্ডে এসে তারা যেন পথভ্রুস্ট হয়ে গেল। বিচারবহির্ভূত হত্যার খেলায় মেতে উঠেছিল কিছু সদস্য। আর এসমস্ত ঘটনা যে শেখ মুজিবের হত্যার জন্য দায়ী নয়, সেটাও আমরা স্পষ্ট বলতে পারিনা। আর সেই হত্যাযজ্ঞ ৫০ বছর পরেও অব্যাহত আছে দেখে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নিজকে যেন ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে।
আজ এখানেই শেষ করি
২৩ শে সেপ্টেম্বর২০২০
No comments