Rape as a social problem / in the eyes of a sociologist

সামাজিক সমস্যা হিসাবে ধর্ষন / একজন সমাজ বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে 





ইদানিং সংবাদ পত্র খুললেই হেডলাইনে যেটা চোখে পড়ে সেটা হল ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ড। কারা এই জঘন্য অপরধের বলী, আবার কারাইবা এই অপরাধের হোতা? আমরা দেখছি যারা সামাজিক ভাবে দুর্বল তাদেরকেই বলী হতে হচ্ছে। মহিলাদেরকে বা আর্থিক দিক থেকে দুর্বল ব্যক্তিদেরকে বা শারীরিক দিক থেকে বিকলাঙ্গদেরকে সাধারনভাবে সামাজিক দৃষ্টি কোন থেকে দুর্বল মনে করা হয়। যদিও এই কনসেপ্টার কিছু পরিবর্তন আসতে শুরু হয়েছে। আমরা ছোট বেলায় দেখেছি কোন মহিলা বা বৃদ্ধলোক বাসে উঠলে পুরুষরা নিজের সিটটা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন সেই কালচার ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে। মহিলারাও মনে হয় সেধরনের কোন সুবিধা নিতে চাইনা বা আশা করে না। কারন সে মনে করে পুরুষের চেয়ে সে কোন অংশেই কম নয়। আবার সেকালে বাসে উঠার মহিলাদের সংখ্যা কম থাকায় অল্প কয়েকজন মহিলাকে বাস বা ট্রেনে জায়গা করে দেওয়া সম্ভব ছিল। এখন কর্মজীবী মহিলাগন কাজের স্বার্থে একাই বাড়ির বাইরে যাচ্ছে, মেয়েরা যাচ্ছে স্কুলে, বাজারে যাচ্ছে গৃহবধুরা। কে কাকে জায়গা করে দিবে। তাই মহিলারা নিজ দায়িত্তে নিজের চলার জন্য বাহন ঠিক করে নিচ্ছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা, শারীরিক শক্তি, তদুপরি পরিহিত কাপড়ের ধরন ইত্যাদি এই ব্যবস্থাকে সহজ করে দিয়েছে। শাড়ির পরিবর্তে এসেছে সালোয়ার কামিজ, আর তাই পায়ে হাঁটার পরিবর্তে এসেছে বাইসাইকেল বা মোটর সাইকেল। এটা ফ্যাশন নয়, প্রয়োজন। অত্যন্ত রিমোট একটি গ্রাম করমদি, সেখানেও মেয়েরা সাইকেল চালাতে শুরু করেছে। অবশ্যই এই মেয়েদেরকে তাদের সাহসের জন্য প্রসংসা করি। বহুদিন আগেই সন্ধানি হাসপাতালের মহিলা স্টাফদেরকে সাইকেল দেওয়া হয়েছিল। তারা সাইকেলটি সুন্দর করে পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে রান্না ঘরের চালের সাথে টাংগিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত লোহার দামে বিক্রয় করেছে।  
 
তবু কেন এধরনের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে? শুধুমাত্র মহিলা বলেই নয়। পুরুষের বেলাতেও সমভাবে প্রযোজ্য। আমরা এও দেখেছি অনেক পুরুষ মহিলাদের অত্যাচারে চাকুরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে, অথবা বৌয়ের লাঠির আঘাতে জখম হয়ে সংসার ত্যাগ করেছে। আমরা ধর্ষণ বা হত্যাকাণ্ড গুলো দেখলে নিশ্চিত হব, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একের সাথে এক নয়, একের সাথে একাধিক। আমরা দেখেছি আফ্রিকার সাফারিতে নিজ বাচ্চা রক্ষা করার জন্য কয়েকটি জিরাফ একত্রিত হয়ে একটা লাইয়নকে কিভাবে ঘায়েল করেছে। ঠিক একই ভাবে একজন মহিলাকে যখন একগুচ্ছ হায়েনা আক্রমন করছে, তখন ঐ মহিলার শরিরে যতই শক্তি থাকুক না কেন, সে শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে যায়। আবার যদি এর পিছনে থাকে অনেক শক্তিশালী বড় ভাইয়েরা যাদেরকে কখনই স্পর্শ করা যায়না, শুধু অনুভব করা যায়। তাই শেষমেশ নিজের জীবনের বিনিময়ে সব পাপের সমাধান করে ইহলোক ত্যাগ করতে হয়।   

সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এই ঘটনাবলিকে কিভাবে ব্যাক্ষা করা যায়। ধর্ষণ বা মার্ডার, এধরনের ঘটনা প্রাচিন কালেও ছিল, এখনও আছে, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু যখন একই ঘটনার বার বার পুনরাবৃত্তি হয়, তখনি সমস্যা। কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ এধরনের নির্লজ্জ কাজ করতে পারে? এর জন্য কি শুধুমাত্র সেই ব্যাক্তিই দায়ী? সমাজবিজ্ঞান এই উত্তর খুঁজে পেতে চায় সমাজ কাঠামোর মধ্যে।  

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপে হঠাৎ করে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে যায়। আত্মহত্যার অর্থ হল কেঊ স্বেচ্ছায় সুস্থ মস্তিষ্কে মৃত্যুকে বেছে নেওয়ার একটা ঘটনা। ১৮৯৭ সালে ফ্রান্সের সমাজবিজ্ঞানী এমীল ডূরখেঈম (Emile Durkheim)তার লেখা বিখ্যাত বই Suicide: A Study in Sociology তে লিখেছেন, সামাজিক সংঘতি এবং নৈতিকতার স্খলনের জন্য মানুষ মূলত আত্মহত্যা করে থাকে। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন সমাজ কাঠামো যখন ব্যক্তিকে ধরে রাখার মত শক্তি হারিয়ে ফেলে, কোথাও যাওয়ার জায়গা পাই না, তখন সে নৈতিক নীতিমালার বন্ধনও হারিয়ে ফেলে। আর তখনই সে একমাত্র আশ্রয় স্থল হিসাবে বেছে নেয় আত্মহত্যা নামে কঠিন এক সত্যকে।  

আচ্ছা সমাজ কাঠামো বলতে কি বুঝায়? একটা বিল্ডিংয়ের যেমন থাকে ফাউন্ডেশন, পিলার, বীম ইত্যাদি, তেমনি আমাদের সমাজে আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আইন শৃঙ্খলা, সরকার প্রথা, অর্থনীতি, বিচার বিভাগ, ধর্ম ইত্যাদি। এগুলোই একটি একটি পিলার, আর এই পিলারগুলোই আমাদের সমাজকে টিকিয়ে রাখে। সমাজে বেঁচে থাকতে হলে এই কাঠামোর নিয়ম কানুন যেমন মেনে চলতে হয়, তেমনি এই কাঠামোর দায়িত্ব হল তার জনগনের নিরাপত্তা দেওয়া। আবার এছাড়া আছে আমাদের পরিবার, পারিপার্শিকতা, আত্মীয় স্বজন। সেখানে আছে কিছু অলিখিত নিয়ম কানুন। এগুলো মেনে চলার পথে আমাদের মূল্যবোধের প্রয়োজন। কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ, সেই বিচার বুদ্ধি এখান থেকেই তৈরি হয়। 

আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর G H Mead তার লিখিত বই Mind, Self and Society তে লিখেছেন আমাদের প্রতিটা মানুষের মধ্যে self অর্থাৎ আত্ম নামের একটা জিনিষ আছে। সেখানে আছে I অর্থাৎ আমি অর্থাৎ আত্মকেন্দ্রিক বা পশুত্তে ভর্তি একটা অস্তিত্ত, আর আছে Me অর্থাৎ অন্যেরা আমাকে কিভাবে দেখছে সেইভাবে নিজেকে বিচার করার একটা বিষয়, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন মন। আর এই বিচারের মাপকাঠি হিসাবে কাজ করে significant others অর্থাৎ সমাজের আইন কানুন বা নৈতিকতা। I এবং Me সর্বদা যুদ্ধ করছে, আর এই যুদ্ধে যে জিতবে, সেগুলো তার কাজের মাধ্যমেই প্রকাশ পাবে। যদি I জিতে যায় তাহলে পশুত্বই তার কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। আর যদি Me জিতে যায়, তাহলে সকলে গ্রহনযোগ্য ফলাফল প্রকাশ হবে।

আমাদের সমাজ কাঠামোর পিলার গুলোকে আজ উই পোকাতে কুরে কুরে খাচ্ছে। পিলারগুলো একদিকে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে উই পোকাগুলো ঐ পিলারগুলো খেয়ে খেয়ে তরতাজা মোটা হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় পোকা গুলোকে ধংশ করার পূর্বে সমাজের পিলারগুলোকে নতুন ভাবে তৈরি করতে হবে অর্থাৎ অপারেশন করে কেটে ফেলতে হবে। তবেই সমাজের রোগগুলো সেরে যাবে। 

আজ আমরা দৌড়াচ্ছি ধর্ষকদের উচ্ছেদ করার জন্য। কিন্তু এই ধর্ষকরা কোথায় জন্মাল, কোথায় বড় হল, কার মদদে বড় হল, সেগুলো খোঁজ না করে দৌড়াচ্ছি খুব সহজে ফল পাওয়ার জন্য। একজন লোক নদীর উজান থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটা সময়ে একজন বাচ্চাকে পানিতে ভাসিয়ে দেয়, আর নদীর ভাটায় অত্তান্ত দুঃখের সাথে সেই বাচ্চাকে উদ্ধার করে একজন দয়াবান ব্যক্তি। এযেন সীমাহীন একটা প্রসেস। আমরা উজানে যেয়ে দেখলাম না সেখানে কি হচ্ছে, শুধুমাত্র ভাটায় বসে হাহুতাস করে সময় ক্ষেপন করছি, সেই সাথে বাড়ছে কফিনের সংখ্যা।  

আজ পৃথিবী জুড়ে স্কুলে ছাত্র ছাত্রিদেরকে শারীরিক বা মানসিক শাস্তি দেওয়া নিষেধ করা হয়েছে, কারন এধরনের শাস্তি দিয়ে ভাল কোন ফল পাওয়া যায় না। আবার অনেক দেশেই ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট অর্থাৎ ফাঁসি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কারন ফাঁসি দিয়ে অপরাধ দমন করা যায় না। সেসব দেশগুলো অপরাধ দমন করার জন্য ফাসির পরিবর্তে স্কুল পরিবেশের উন্নয়ন করেছে, সামাজিকিকরনের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। দায়িত্ববান নাগরিক তৈরি করেছে, ভাল মন্দ বিচার করার ক্ষমতা সম্পন্ন নাগরিক তৈরি করেছে, দেশকে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য লিডার তৈরি করেছে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হল How to make a differene অর্থাৎ একে অপরের সাথে কিভাবে পার্থক্য তৈরি করা যায়, একে অপরকে পরিক্ষার খাতার নম্বরের ভিত্তিতে ছোট বড় বিচার করা যায়। আর পশ্চিমা উন্নত দেশের শিক্ষার উদ্দেশ্য হল How to live a good life অর্থাৎ কিভাবে সুন্দর জীবন যাপন করা যায়, শুধু নিজেই ভাল থাকা নয়, অন্যেরাও যেন ভাল থাকে সেই বাবস্থা করা যায়। এজন্য শুধুমাত্র সরকারই নয়, গোটা জাতিকে সমবেত ভাবে কাজ করতে হবে।  
 

 ১৩ই অক্টোবর ২০২০

No comments

Powered by Blogger.