স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২২ হিন্দা গ্রামে গণহত্যা / বন্ধু আজিজুলের বিদায়। Some memories of independence 22 Massacre in Hinda village / Farewell to friend Azizul

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২২  হিন্দা গ্রামে গণহত্যা / বন্ধু আজিজুলের বিদায় 

আচ্ছা বলতে পারেন যুদ্ধে সাধারন মানুষের মৃত্যুর হার কত? আমরা মনে করি যুদ্ধ মানেই খাকি পোশাক ধারি দুই দল অস্ত্র্র হাতে নিয়ে বাহাদুরি দেখানো, লড়াই করা, দুই শক্তির মারামারি, কাটাকাটি, শেষে একদলের গলা কর্তন অথবা আত্ম সমর্পণ। কিন্তু আদৌ তা নয়। বাস্তবে কি হয়, সশস্ত্র সামরিক বাহিনীর কতজন লোক যুদ্ধে মারা যায়, আর কতজন বেসামরিক লোকের জীবন যায়? ষাঁড়ে ষাঁড়ে যুদ্ধ করে উলু খড়ের প্রান যায়। বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর হার ৯০%, এবং এর বিরাট একটা অংশই হল মহিলা এবং নাবালগ ছেলেমেয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এর ব্যাতিক্রম নয়। আমরা যদি তেঁতুলবাড়িয়া  ইউনিয়নের তথ্য নিই, সেখানেও একই সংখ্যা বের হয়ে আসবে। এখানে মুক্তিযোদ্ধা কতজন মারা গেছে, আর সাধারন মানুষ যাদের সাথে যুদ্দের আদৌ কোন সম্পর্ক ছিলনা তারাই বা কতজন এই জগৎ থেকে বিদায় নিয়েছে? আমাদের তথ্য অনুসারে তেঁতুলবাড়িয়া ইউনিয়নে ১৫ জন বেসামরিক লোক মৃত্যু বরন করে, অথচ একজনও সামরিক লোক মারা যায় নাই।   

তারিখ টা এখনও অস্পষ্ট, তবে ১৯৭১ এর অক্টোবর মাসের শেষের দিকের কোন এক দিন। জানিনা দিনটি কেমন ছিল। কাল আকাশ না নীল আকাশ? সাদা আকাশ না লাল আকাশ? সকাল বেলায় কোন পাখিটা কেমন ডেকেছিল? কান্নার গান না সুখের শ্রুতিমধুর আওয়াজ? কৃষক ভাই রাত্রি বেলায় কি সপ্ন দেখেছিল, জমি ভরা ফসল না বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া অনেক যত্ন করে বড় করা পুকুরের মাছ? সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে কার মুখ দেখেছিল? সে কি তখনও জানত তার হায়াত শেষ হয়ে আসছে। এই পৃথিবীর মায়া তাকে ত্যাগ করতে হবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই? 

আমাদের ক্লাসফ্রেন্ড আজিজুল হক পিতা সুরাত মিস্ত্রি, হিন্দা গ্রামের উত্তর পাড়ায় বাড়ি। আমরা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত একসাথে লেখাপড়া করেছি। খুব মোটাসোটা মানুষ। বয়সে হয়তো আমাদের চেয়ে একটু বেশী হতে পারে। শরীরের রং কাল কুচকুচে। খুব সহজ সরল মানুষ। ওকে নিয়ে অনেক দুষ্টুমি করেছি। ওদের বাড়ি থেকে করমদি হাইস্কুল আনুমানিক ৭ কিলো হবে। শুকনা দিনে সাইকেলে আসতো। বর্ষার দিনে সাইকেল তো প্রশ্নই উঠে না, পায়ে হেঁটে আসাও দুস্কর ছিল। এক হাঁটু কাদা পানি পাড়ি দিয়ে সে প্রতিদিন স্কুলে আসতো। ঘামে শরীর ভিজে থাকত। পুরুষের শরীর দিয়ে নাকি এমনিতেই গন্ধ বের হয়, তদুপরি যদি শরীর ঘামে, তাহলে কি অবস্থা নিশ্চই বুঝতে কষ্ট হবেনা। এই নিয়ে আমরা অনেক সময় ওর পাশে বসতে চাইতাম না। কিন্তু কে জানে তার পাশে আর কাউকেই বসা লাগবেনা। 

আমরা যখন স্কুলে পড়ি, তখনো আমরা পাকিস্তানের নাগরিক, তাই স্বাভাবিক ভাবেই ১৪ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করতাম। আমাদের স্কুলটি তখন করমদি হাটের উপর, যেখানে প্রাইভেট স্কুল তৈরি হয়েছে।  সকলে চাঁদা তুলে খাবার দাবারের আয়োজন। আগের দিন থেকেই উৎসব উৎসব ভাব। সব চেয়ে সমস্যা হল হাঁড়ী পাতিলের ব্যবস্থা। এখনকার মত তো আর ডেকরেটার ছিল না। আমাদের মৌলভি স্যার ক্লাসের  সকলকে জিজ্ঞাসা করছেন তোরা কে কি দিবি, কেউ কোন উত্তর করেনা। স্যার আমাকে বললেন কিরে কোন কথা বলিস না কেন? আমি একটু রাগ করেই স্যারকে বললাম, স্যার, আমি সবগুলো দিব। কিন্তু একটা শর্ত, এগুলো আনা এবং ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব আপনার। স্যার রাজি হলেন, কিন্তু সত্যিকারে কে যাবে? ঠিক হল আজিজুল সহ কাজিপুরের ছাত্ররা আনতে যাবে। তাই হল। ভুসি রাখার বিরাট ডালা থেকে শুরু করে হাড়ী পাতিল পর্যন্ত। অন্যেরা আপত্তি করলেও আজিজুল কখনই না বলে নাই। এটা যেন তার অভিধানের বাইরের শব্দ।

আজিজুল ঘুম থেকে উঠার অল্প কিছু সময় পরেই একদল হায়েনা বিনা অনুমতিতে ওদের বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল। কেউ কোন শব্দ করার আগেই আজিজুলের চোখ দুটো বেঁধে ফেলল।  সেইসাথে হাত দুটো ঝটপট করে পিছমোড়া দিয়ে বাঁধল। তারপর নিয়ে চলে গেল অজানা কোন এক জায়গায়। তার বাড়িতে মা বাবা ভাইবোন আকাশ চেরা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। কিন্তু কে কার কান্না শুনে। মায়ের কান্না কি তাদের কানে কখনও পৌছায়? এছাড়া আজিজুলকে তার বাবা মা শখ করে ছোট বেলাতেই বিয়ে দিয়েছিল, পলাশীপাড়ার চাঁদ ডাক্তারের মেয়ের সাথে। একটা ছেলেও হয়েছিল। আজিজুলের মৃত্যু একই সাথে বাবা মাকে করল সন্তান হারা, অল্প বয়সী বউকে করল বিধবা, দুধের ছেলেকে করল পিতৃহারা। ছেলেটি বর্তমানে বিআরবি তে চাকরি করে, কুষ্টিয়াতে মা ও তার সাথে থাকে। নাতিপুতি নাকি হয়েছে। তাদেরকে নিয়েই হয়তো স্বামীকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আদৌ কি ভুলে যাওয়ার বিষয়? 

আজিজুলের সাথে আরও তিনজনকে ধরে আনা হল। তারা হল আবুল কাসেম পিতা শাকের গাইন সাং ধর্মচাকি, মোহাম্মদ হামিদুল পিতা রিয়াজউদ্দিন গ্রাম হিন্দা, আব্দুল বারী পিতা জুবান শেখ গ্রাম হিন্দা। তাদের সবাইকেই একই সময়ে একই কায়দায় ধরে নিয়ে যায় একই গ্রামের হাজি আখের মণ্ডলের বাড়িতে। হাজি আখের মণ্ডল হচ্ছে আজমাইন এবং প্রাক্তন এম পি আমজাদ হোসেনের বাবা। আখের মণ্ডলের সাথে পাক বাহিনী বা রাজাকারদের আদৌ কোন সম্পর্ক ছিল কিনা জানিনা। তাদের বাড়িটা চারদিকে ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভিতরে ধরে নিয়ে আসা ব্যক্তিদেরকে অত্যাচার করলেও বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না। আখের মণ্ডলের বাড়ির গেটের পশ্চিম পাশে এই ৪ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আজিজুলের বাবা কিছু টাকা নিয়ে আখের মণ্ডলের বাড়িতে যায় ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য, কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই তিন ব্যাক্তির আত্মীয় স্বজনকে লাশের নিকটে ভিড়তে দেওয়া হয় নাই।
 আজিজুল, হামিদুল্ এবং আব্দুল বারিকে হিন্দা গোরস্থানে মাটিচাপা দেওয়া হয়। কাফন বা জানাজা কিছুই করানো হয় নাই। মাটি চাপা দেওয়ার জায়গাটি এখন আর চেনা যায় না। তারা যেমন মাটির সাথে মিশে গেছে, তেমনই মানুযের মন থেকেও হয়তো মিশে গেছে। আবুল কাশেমকে তার নিজ গ্রামে দাফন করা হয়। তথ্য সরবরাহে আব্দুল লতিফ (আজিজুলের ভাইপো), হাসান বশির (আজিজুলের ভাইপো)এবং একরামুল হক (সন্ধানি সংস্থার প্রাক্তন উপ পরিচালক)।

রফিকুর রশিদের লেখা মেহেরপুরের মুক্তিযুদ্ধ বইয়ে উল্লেখ আছে ১৯৭১ সালের ১৫ই অক্টোবর হিন্দা গ্রামের আজিজুল হক পিতা মওলা বকশ, মুক্তিযোদ্ধা মুন্তাজের বাবা বাবুর আলী, মঞ্ছুর আলী এবং নুর বকশ, নওয়াপাড়া গ্রামের আফসার মালিথা, জবতুল্লাহ, সাকের আলী এবং মজিবর রহমান কে ধরে নিয়ে আসে, এবং হিজলবাড়িয়ার টেপুখালি মাঠে ৪টা গুলি দিয়ে ৮ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের লাশ মাঠের মধ্যে ৩ দিন পড়ে থাকে। যে জমিতে লাশগুলো পড়ে ছিল সেই জমির মালিকের অনুরোধে লাশগুলো দুইটা মাটির গর্ত করে বিনা কাফনে, বিনা জানাজাই পুঁতে রাখা হয়। এযেন বন্য পশুর সৎকার। যারা বিস্তারিত জানতে আগ্রহী,  মেহেরপুরের মুক্তিযুদ্ধ বইটির ১৮৬ পৃষ্ঠা খুলে দেখতে পারেন।

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২২  হিন্দা গ্রামে গণহত্যা / বন্ধু আজিজুলের বিদায়  ourkaramdi village

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২২ 
হিন্দা গ্রামে গণহত্যা / বন্ধু আজিজুলের বিদায় 




আজ এখানেই শেষ  ১৮ই জুন, ২০২০

copyright from Facebok. 

No comments

Powered by Blogger.