স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২১ : ইয়াকুবের হাসি কে যেন হঠাৎ করেই কেড়ে নিল।

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২১
 
ইয়াকুবের হাসি কে যেন হঠাৎ করেই কেড়ে নিল 


ইয়াকুব আলী, পলাশিপাড়া গ্রামে বাড়ি। উকিল থান্দারদের বাড়ির নিকটে, কাজলা নদীর ঠিক উপরে বললেও ভুল হবে না।  আমরা করমদি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং হাইস্কুলে গোটা ১০ বছর এক সাথে লেখাপড়া করেছি। আমরা যারা ক্লাসে ভাল ছাত্র নামে পরিচিত ছিলাম, তাদের চেয়ে ইয়াকুবই ছিল জনপ্রিয়। ছাত্র হিসাবে যে খুব ভাল ছিল, সেটা বলা যাবেনা। কিন্ত স্কুলে তাকে চেনেনা এমন কেউ ছিল না। কতবার যে ওদের বাড়িতে গিয়েছি, খেয়েছি, তার হিসাব নাই। স্কুলের সকল ছাত্র শিক্ষক কেন তাকে চিনত, তার একটা কারন আছে। ইয়াকুব ছিল কমেডিয়ান। স্কুলে এমন কোন প্রোগ্রাম ছিল না যেখানে ইয়াকুব নাই। মঞ্চে দাঁড়ানোর সাথে সাথে  দর্শকদের চেহারা পরিবর্তন। ইয়াকুবের কথা শোনার আগেই হাসিতে ভরপুর হলঘর। ওর দাঁড়ানোর স্টাইল, তাকানোর  ভঙ্গি দেখলে না হেসে পারা যেত না। একদিন আমাদের ক্লাসে কোন একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোফাজ্জেল স্যার সবাইকে মেরেছিলেন। যেই মাত্র ইয়াকুবের কাছে স্যার এসেছেন, ওকে মারার কথা ভুলে যেয়ে স্যার হেসে উঠলেন। স্যার বললেন, না, আর পারলাম না, আমি হেরে গেলাম। স্যারের এই কথাই আমরা বেতের আঁচড়ের ব্যাথা ভুলে যেয়ে হেসে উঠলাম।

সেই ইয়াকুবের মুখ থেকে চিরদিনের জন্য অত্যান্ত  আকস্মিক ভাবে তার চিরন্তন হাসি কে যেন কেড়ে নিল। ইয়াকুব সবে মাত্র এস এস সি পাশ করেছে। ৮ই স্রাবণ ১৩৭৮, বা ১৯৭১ সালের ২৩ শে জুলাই শুক্রবার বেলা  আনুমানিক ১২ টার দিকে। ইয়াকুবের কাছ থেকে চির দিনের জন্য ছিনিয়ে নিল তার বাবাকে। ঘটনাটি কিভাবে ঘটেছিল, একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

২২ শে জুলাই ১৯৭১। ভাটপাড়া পাক আর্মি ক্যাম্প থেকে কিছু সেনা সদস্য তেঁতুলতলা ইপিআর বা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমন করতে আসে। বলে রাখা ভাল, মথুরাপুর এবং তেঁতুলবাড়িয়া গ্রাম দুটোর মাঝখানে তেঁতুলতলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ছিল। এটাই সম্ভবত তাদের টার্গেট ছিল। এর পিছনে আরেকটা যুক্তি আছে। এই সেই স্থান যেখানে স্বাধীন বাংলা এবং ইন্ডিয়ার সাথে মালাবদল হয়। পাক আর্মিরা হিন্দা হয়ে পলাশিপাড়ার মেইন রোড ধরে তেঁতুল বাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত এসেছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনের সাথে টিকে থাকতে না পেরে পাক আর্মিরা পিছু টান নেয়। তারা মেইন রাস্তা দিয়ে যেতে ভয় পায়, শেষ পর্যন্ত তারা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে থেকে মাঠের মধ্য দিয়ে ফরমান বিশ্বাসের বাড়ির দক্ষিন দিকের মাঠ পাড়ি দিয়ে পলাশিপাড়া এবং হিন্দার মাঝখানে যে ব্রিজ আছে ঐ দিকে লক্ষ্য করে হাঁটা শুরু করে। সাথে নিশ্চয়ই স্থানীয় রাজাকার ছিল, তানাহলে পাক আর্মির পক্ষে সম্ভব নয় এমন একটা অজ পাড়া গাঁয়ে আসা। ব্রিজে পৌছিয়ে পরাজিতের গ্লানি মুছে ফেলার জন্য মনে করে কিছু একটা করা দরকার। তাই তারা ঐ ব্রিজের দুপাড়ে দুইটা বা তিনটা anti personnel mine  পুঁতে রাখে। এখানে anti personnel mine সম্পর্কে কিছু বলতে হয়। আসলে এই মাইনটি আবিস্কার করে রাশিয়ার একজন বিজ্ঞানী। উদ্দেশ্য হল মানুষ মারা নয়, মানুষকে পঙ্গু করা। এর অপর নাম হচ্ছে evil weapons. একজন লোক মারা গেলে তার জন্য দাফন কাফন ছাড়া বিশেষ কোন খরচ করা লাগে না। কিন্তু একজন মানুষ পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকলে সে তো নিজে কোন উপার্জন করতে পারবেনা, বরং তাকে খাওয়া, চিকিৎসা দিতে হবে, পরিচর্যার জন্য লোক রাখা লাগবে। তাই মুত ব্যক্তির চেয়ে জিবিত ব্যাক্ত্রির জন্য খরচ অনেক বেশী। শত্রু  পক্ষকে ঘাইল করার জন্য এই অস্ত্রটিই হল সবচেয়ে  মারাত্মক। এই মাইনটির উপর অংশে একটা ফিউজ থাকে। ফিউজের সাথে খুবই চিকন একটা তার লাগানো হয়। তারটি এমনই সুক্ষ যে অনেক সময় খালি চোখে দেখা যাইনা। মাইনের উপর সরাসরি পায়ের চাপ পড়লে তো প্রশ্নই নয়, তারের সাথে কোন না কোন ভাবে ছোঁয়া লাগলে ও মাইনটি বিস্ফোরণ করবে।

পরদিন অর্থাৎ ২৩ শে জুলাই সকাল ৯ টা বা সাড়ে নয়টার দিকে ইয়াকুবের বাবা বয়েন উদ্দিন ব্রিজের পাশে পুঁতে রাখা মাইনের তারের সাথে পা পড়ে যায়। মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। কিছু সময় পর তার মৃত্যু হয়। বয়েন উদ্দিনের সাথে ছিল ইয়াকুবের একমাত্র শ্যালক টলা। ৮ম শ্রেনির ছাত্র। টলার বাড়ি ভোমরদহ গ্রাম। বাবা নজীর হোসেন। বয়েন উদ্দিন টলাকে কিছুদুর এগিয়ে দেওয়ার জন্য সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিল। মাইন এমন একটা জিনিষ যে সে কখনই কোন আত্মীয় বা ছেলে না মেয়ে বা ছোট না বড় কিছুই মানে না। সমাজতান্ত্রিক শাসন। টলার নাভি হতে উপরের ডান দিক সম্পূর্ণটাই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। একরামুল টলারের জানাজায় অংশ নিয়েছিল, এবং সব কিছুই সচক্ষে দেখেছে। একজন নাবালগ অথচ সম্ভাবনাময় ছেলেটি বাবা মার কোল খালি করে এই পৃথিবী থেকে অকালেই বিদায় নিল। তার বাবা মা বা আত্মীয় স্বজনের  জন্য সে কি রেখে গেল? শুধু হাহুতাস আর আর্তনাদ, আত্মকান্না ছাড়া? বাবা মা ছাড়া এ ব্যাথা অনুভব করার মত এ পৃথিবীতে কে আর আছে? পলাশিপাড়ার আরজেল মুন্সি আহত হয়, করিমপুরে হাস্পাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠে, এখন ও জীবিত।   

এই ঘটনার ছয় সাত দিন পর একই জায়গায় আরেকটি মাইন বিস্ফোরণ করে। আর সেই বিস্ফোরণে তেঁতুল বাড়িয়া গ্রামের ছুরাল হোসেন নামে এক ব্যাক্তি মারা যায়। হিন্দা গ্রামের আতাহার আলী নামক এক ভদ্রলোক ব্রিজের নিকট এসে পলাশি পাড়ার ওয়ারেস আলী নামের একজন কে ডেকে বলে তুমি ব্রিজের উত্তর দিক পাহারা দাও, আমি দক্ষিন দিক পাহারা দিচ্ছি। কিন্তু কে কার কথা শোনে। তাদের সামনেই ছুরাল হোসেন মাইনের তারে পা দেয়, এবং মাইনটি বিস্ফোরণ করে। আর সেই মাইনেই ছুরাল হোসেনের মৃত্যু হয়। (তথ্য সংগ্রহে একরামুল হক, সন্ধানী সংস্থার সাবেক উপপরিচালক)। পাঠকদের নিকট ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি শেষ অংশটির তথ্য প্রমানিত নয়। কোন ভুল থাকলে সংশোধন করানোর জন্য তথ্য দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।

এই ঘটনাটি যখন ঘটে, আমরা তখনো মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসি নাই। আমরা সচক্ষে এই ঘটনাটি দেখি নাই। বাংলদেশে ফিরে এসে ইয়াকুবের সাথে দেখা করি এবং এসব কথাবার্তা শুনি। হঠাৎ করেই ভিন্ন এক ইয়াকুবের সাথে দেখা হল।
ইয়াকুব বছর তিনেক আগে হঠাৎ করেই আমাদের সবাইকে বিদায় জানিয়েছে। ইয়াকুবের ছোট ভাই ময়েনের সাথে গাংনি    থানা    কাউন্সিলের সামনে দেখা। "ভাই একটু অসুস্থ, সম্ভব হলে দেখা কইরেন।" আমি পরদিন ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসলাম। আমি গাড়ী থামাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার  স্ত্রী  বলল, আজ খুব গরম, কাল তুমি একা এস। পরদিন সকাল ৬ টার সময় ঢাকাবাসি নজরুলের থেকে টেলিফোন পেলাম, ইয়াকুব মারা গেছে। দুপুরে ইয়াকুবের বাড়িতে গেলাম, কিন্ত মরা মুখ দেখার জন্য। ওর বউ, ছেলে, মেয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, আমি কোন ভাবেই নিজেকে সামাল দিতে পারলাম না। নিজেকে খুব দোষী অনুভব করলাম।  ইয়াকুব অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরে ছোট ভাইগুলোকে মানুষ করেছে, ছোট বোনটাকে বিয়ে দিয়েছে। ওর সমস্ত দায়দায়িত্ব শেষ করে চির নিদ্রায়। আল্লাহ তোকে বেহেশত বাসি করুক। পরজগতে তোর সাথে দেখা হবে।

পাক আর্মির সাথে যুদ্ধে কারা অংশ নিয়েছিল সেই তালিকাটিও এখন আমাদের হাতে নাই। কেউ সহযোগিতা করলে কৃতজ্ঞ থাকব।

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২১   ইয়াকুবের হাসি কে যেন হঠাৎ করেই কেড়ে নিল our karamdi village
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২১   ইয়াকুবের হাসি কে যেন হঠাৎ করেই কেড়ে নিল 




আজ এখানেই শেষ


copyright from facebok. 

No comments

Powered by Blogger.