স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২৩ মিনাপাড়াই রাজাকার নিধন এবং তার ফলাফল

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২৩

মিনাপাড়াই রাজাকার নিধন এবং তার ফলাফল 


অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখ, ৯ই রমজান ১৩৯১। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। কাকতালীয় ভাবেই আমি সেদিন মিনাপাড়ার আশরাফুলদের বাড়িতে। নিত্যদিনের মতই সেদিন আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা করে গল্প গুজব করছি। দুপুরটাও একই ভাবে কাটল। এই বাড়িতে আমি নতুন মুখ নই, আমি যেন তাদেরই একজন। আমার জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিলনা। আশরাফুলের দুই চাচা, জুবায়ের এবং শাহাবুদ্দিন, তখনও কলেজের ছাত্র। পরে অবশ্য তাদের দুজনকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পেয়েছি এবং আমরা কাজলাতে একই মেসে কিছুদিন কাটিয়েছি। তাদের আদর যত্ন কখনই ভুলবার নয়। জুবায়ের চাচা অল্প বয়সে ইহলোক ত্যাগ, শাহাবুদ্দিন ctচাচা গাংনী কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। 
  

এই সময়ের কিছুদিন আগে আমাদেরই সহযোগী সাবেক এম পি মকবুল হোসেনের নানা গফুর মণ্ডল মৃত্যু বরন করেন । মিনাপাড়া গ্রামের পূর্ব পাড়ায় উনাদের বাড়ি। তারই কূলখানির ব্যাবস্থা। বেশ কিছু লোকজনকে দাওয়াত করা হয়েছে। প্যান্ডেলের পাশ দিয়ে একদল রাজাকার হাট বোয়ালিয়া অথবা আশে পাশে কোথাও কোন গ্রামে যাচ্ছিল। যেহেতু রমজান মাস, তাই তারা ফেরার পথে ইফতারি করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তাদেরকে তো আর নিষেধ করা যাইনা। ওই একই স্থানে মুক্তিযোদ্ধা রহমান চুরিওায়ালা এবং নান্নু সেখানে উপস্থিত। তাদেরকে দাওয়াত করা হয়েছিল কিনা অস্পষ্ট। রহমান চুরিওয়ালা খুব মোটা তাজা  মানুষ, সেই সাথে মনের জোরও সাংঘাতিক। হঠাৎ করেই যেন সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেল। রহমান এবং রাজাকারদের ভিতর শুরু হল গোলাগুলি। ঘটনা স্থলেই ২জন রাজাকারের মৃত্যু। বাকিগুলো এদিক ওদিক পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা। কয়েকজন রাজাকার বাইলি গাড়ি মাঠের দিকে পালাবার চেষ্টা করে, সেখানে স্থানীয় লোকজনের  খপ্পরে পড়ে প্রান হারায়। আশরাফুলের বাবা মোঃ জুল হক মিয়া এই সংবাদটি মকবুল এবং দুলু কে দেন।  

সঠিক সময়টা মনে নাই, তবে তারাবি নামাজের কিছু আগের ঘটনা। মকবুল এবং দুলু একটা রাইফেল নিয়ে হাজির। বেয়োনেটে তখনো তাজা রক্তের ছোঁয়া। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে এই প্রথম রক্তের সংস্পর্শে আসা। নিহত ব্যাক্তি যেই-ই হোক না কেন, আজিজুল বা টলারের মত সেও তো কারো না কারোর সন্তান, কারোর ভাই। সেও এই পৃথিবী থেকে চলে গেল একাকীত্বই, তার মূখে একফোঁটা পানি দেওয়ার মতো কেউই নাই। লাশ গুলো কি তাদের বাড়িতে পৌঁছিয়েছিল?  দাফন কি হয়েছিল? 

আমি খুব চিন্তাই পড়ে গেলাম। এই ঘটনাটি ঘটল গ্রামের ঠিক মাঝখানে, অতএব  এর ফল কি হতে পারে তা অনুমেয়। মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসাবে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পরদিন সকাল পর্যন্ত আর অপেক্ষা নয়। গ্রামের মানুষ যে যেদিকে পারছে ছুটছে আর ছুটছে। দীর্ঘদিনের সাজানো সংসারের কি-ই বা সাথে করে নেওয়া যায়। আমরা রওয়ানা  িদলাম আশরাফুেলর মামা বাড়ী রুয়ের কান্দি গ্রামে, মাবুদ মামুর বাড়ি। ওর চাচারাও সাথে গেল। ওদের বাড়ির মোটর সাইকেল, গোলা ভরা ধান, ফসল, লেপ কাঁথা ইত্যাদি গাড়ি ভর্তি করে গ্রাম ত্যাগ। এ যেন ভিন্ন ধরনের শরণার্থী। রাত্রি বেলাতেই সব কাজ সম্পন্ন করতে হবে, কারোর চোখে নাই এক চিলতে ঘুম। আমরা আমাদের রাইফেলগুলো পলিথিন দিয়ে জড়িয়ে মাবুদ মামুর পুকুরে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় নিতে বললাম। ওদের জন্য এর চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় আর কোথাই-ই বা পাওয়া যাবে।    

আমরা যা আশা করেছিলাম, সকাল হতে না হতেই তার আবির্ভাব। মিনাপাড়া জ্বলছে। আমরা ছোট বেলায় দেখেছি পোকা মাকড় ধ্বংস করার জন্য আমন ধানের মাঠে আগুন জালানো হত। কৃষকরা আগুন জালিয়ে হয়তো মজা করে দেখত, তাদের আগুনে কতটা প্রান নিধন হল। আমরা দেখতে পাচ্ছি একদল লোক এক বাড়ির আগুন অন্য বাড়িতে লাগিয়ে দিচ্ছে। দবদব করে বাড়িগুলো জ্বলছে, কোন কোন জায়গা থেকে আতস বাজির মত বিকট শব্দও হচ্ছে। যারা এই বনফায়ার করছিল, তারা জানিনা কি না আনন্দে মসগুল ছিল। আমরা দূর থেকে এই চিত্র দেখলেও ভয়ও হচ্ছিল। ওই হায়েনা গুলো আমাদের দিকে ধেয়ে আসবে নাতো? দুপুরের দিকে সংবাদ এল পাক বাহিনীরা চলে গেছে। তখন লোকজন নিজ নিজ বাড়ির ধ্বংসলিলা দেখতে একপা দুপা করে আগাচ্ছে। আমরা বিকালের দিকে অতি সাহস নিয়ে গ্রামের মানুষের একজন সেজে অগ্রসর হলাম। তখনও বাড়ি পুড়ছে, সেই সাথে আরও অনেক কিছু। শুনেছি কয়েকটি ছাগলও পুড়ে রোষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পোড়া গন্ধ আশে পাশের গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। ধান ভরা গোলাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়, আর সেই আগূনে ধান গুলো কাল কীশকীশে রূপ নিয়েছীল।      
  
টিপটিপে বৃষ্টির দিন। গ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় চাল ডাল সাথে করে নিয়ে আসলেও আগুন তো আর  আনা হয়নাই। বৃষ্টির দিনে জালানি কাঠ গুলো ভিজে গেছে, আগুনের সাথে ধোঁয়া যেন যুদ্ধ শুরু করেছে। এমন পরিবেশে রান্না করা খুব একটা সহজ নয়। এছাড়া আমরা মানে শরণার্থীদের সংখ্যা তো কম নয়। খাবার বলতে ভাত, একটা সবজি, আর ডাল। আশরাফুলের মা দুঃখ করে বলেলন, যা হয়েছে তাই দিয়ে দুমুঠো খেয়ে নাও বাবা। কিন্তু সেই খাবার গুলোই যে কেমন সুস্বাদু ছিল সেটা আজ শুধু অনুভুতির ব্যাপার।   
   
এদিকে আমাদের বাড়িতে তুলকালাম শুরু হয়ে গেছে। মিনাপাড়ার আগুনের সংবাদ আমাদের বাড়িতেও পৌঁছেছে। কিন্তু কিভাবে সংবাদ নিবে? আমাদের পাড়ায় কানু চাচা নামে একজন লোক ছিল। গরীব মানুষ, কিন্তু বেশ শক্তিশালী। ছাব্বাণ চাওয়ালার চাচা। আমার বাবা কানু চাচাকে পাঠাল আমার সংবাদ নেওয়ার জন্য। সে বামন্দি পর্যন্ত যেয়ে ফিরে এসে বলল, বামন্দি পার হওয়া যাবেনা। কোন খোঁজ খবর পাওয়া গেলনা, ইত্যাদি। আমাদের বাড়িতে তো কান্নার রোল, কিন্তু চিৎকার করে নয়। চীৎকার করতে ্যে মানা। 

শুধু মিনাপাড়া নয়, আশেপাশের গ্রামেও একটা আতংক বিরাজ করছে। আমদের ট্রেনিং প্রোগ্রাম ও আপাতত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অবস্থা একটু স্বাভাবিক হলে আমরা আবারো রাত্রি বেলায় ব্রজনাথপুরের উদ্দেশে রুয়েরকান্দি ত্যাগ করলাম। মাঝখানের স্টেশন, আমাদের বাড়ি। বাবা মাকে আশ্বস্ত করন, সেই সাথে মায়ের হাতের দুমুঠো ভাত। 

রফিকুর রশিদের লিখিত “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মেহেরপুর জেলা” ১৮৭ পৃষ্ঠায় লেখা আছে রাজাকার নিধনের দুইদিন পর পাক বাহিনীরা মিনাপাড়া গ্রামে আগুন জালিয়ে দেয়, আসলে দুইদিন পর নয়, পরদিন ভোর বেলায়।

our karamdi village স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২৩ মিনাপাড়াই রাজাকার নিধন এবং তার ফলাফল

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২৩

মিনাপাড়াই রাজাকার নিধন এবং তার ফলাফল 




আজ এখানেই শেষ       ২৩শে জুন ২০২০

copyright from facebok ID

2 comments:

Powered by Blogger.