স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১১/Some memories of independence 11
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি 11 of Mokhlesur Rahman
স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্দেশে্ বারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ
অবশেষে এক সপ্তাহ বা তার একটু অধিক সময় বারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে কাটানোর পর এক সন্ধায় ডিনার শেষে আমাদের ডাক আসল কেন্দ্রীয় অফিস থেকে। এখানে কেন্দ্রীয় অফিস বলতে একই ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে অবস্থিত ছাত্র নেতাদের কার্যালয়ের কথা বলা হচ্ছে। মেহেরপুর এবং গাংনী থানার বাসিন্দাদেরকে একই সাথে জড় হওয়ার জন্য বলা হল। কি উদ্দেশে ডাকা হচ্ছে, সেটা স্পষ্ট না হলেও কিছুটা অনুমান করতে পারছিলাম। এছাড়া ছাত্রনেতাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল বড় ভাই-ছোট ভাইদের মত। আমরা আমাদের সুবিধা অসুবিধা সবকিছুই অনায়াসে তাদেরকে বলতে পারতাম।
আমাদেরকে বলা হল ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানের সময় ঘনিয়ে এসেছে। পরদিন সকাল থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কাজের সুবিধার জন্য টীম তৈরি করা হল। সংগঠিত বাহিনীর অনুরুপ না হলেও আমাদের চেইন অব কমান্ড থাকার প্রয়োজন। আমাদের টীম লিডারের দায়িত্ব দেওয়া হল করমদি গ্রামের গোসায়ডুবি পাড়ার মোফাজ্জেল হোসেন কে। কারন উনি ছিলেন আমাদের সকলের বয়োজ্যেষ্ঠ, এবং শিক্ষার দিক থেকেও এগিয়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই উনি মেহেরপুর কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। আর আমরা সকলেই এস এস সির পরীক্ষার্থী অথবা তার আশে পাশে। আর আমাকে সহলিডার বানানো হল। প্রকৃতপক্ষে আমার চেয়ে বয়সে বড় এমন দুইএকজন ছিল, যেমন করমদি গ্রামের আব্দুল কাদের, কাজিপুরের আশরাফ ভাই, মিনাপাড়ার মকবুল হোসেন। আর মিনাপাড়ার আশরাফুল ছিল সর্বকনিষ্ঠ, সে তখন মেহেরপুর হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। বয়স কম হলেও তার শারীরিক গঠন ছিল খুবই চমৎকার, পাতলা হালকা, লম্বা, খুবই ফরসা। কেন যেন অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।
যদিও আমাদের নিজ নিজ এলাকায় কাজ করার জন্য বলা হল, কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য নিম্নতম কিছু অস্ত্র আমাদেরকে দেওয়া হল। টীম লিডারের জন্য এস এল আর, আর আমাদের জন্য থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও কিছু গুলি, কতগুলো গুলি দেওয়া হয়েছিল সংখ্যাটি মনে নাই, তবে খুব বেশিও নয়। এছাড়া আমাদের প্রত্যেককে দুটি করে হ্যান্ড গ্রেনেড, ছোট খাট ব্রীজ বা বিল্ডিং ভাঙ্গার জন্য কিছু ডেটোনেটার এবং এক্সপ্লোসিভ। এগুলোর ব্যাবহার কখনই হয় নাই।
এপর্যন্ত আমরা এক্যাম্প থেকে ওক্যাম্পে গিয়েছি, সব জায়গাতেই আমাদের জন্য খাবার, বিছানা, কাপড় চোপড়, গোসলের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যাবস্থা ছিল। কিন্ত এখন থেকে আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেটা সম্পূর্ণ অজানা। শুধু তাই নয়, অতি বিপদকে সামনে নিয়ে। বিপদই যেন আমাদের নিত্য সঙ্গী। যেকোন সময় যেকোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কয়েনের এপিঠ আর ওপিঠ। আমাদেরকে কিছু নগদ টাকা দেওয়া হল। আমরা যেন অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে থাকি, না খেয়ে থাকি সেজন্য। আবার খুধা নিবারনের জন্য কাউকে যেন পীড়া না দিই সে সাবধান বানিও বারবার শুনানো হল।
আমরা পরদিন দুপুরের পর বারাকপুর থেকে রওয়ানা দিলাম, বাস না ট্রাক, আমার মনে নাই। জন্মভুমিকে স্বাধীন করার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা। কিন্তু কোথায় যাব, কিভাবে যাব, কার সাথে যাব, সবই অনিশ্চিত। কোথায় যাচ্ছি বলা হলনা। আমাদের নিরাপত্তার জন্য এধরনের গোপনীয়তা। আমাদের অবস্থান সম্পর্কে শত্রু পক্ষ আগে থেকে জেনে গেলে নির্ঘাত আমাদের মৃত্যু। আমাদের সবাইকে একটা করে ব্যাকপ্যাক দেওয়া হল যার মধ্যে নিজস্ব কাপড় চোপড় ছাড়াও দুটি করে হ্যান্ড গ্রেনেড, গুলি বারুদ নেওয়ার জন্য। রাইফেলটি কাঁধে ঝুলিয়ে। আমরা যাচ্ছি তো যাচ্ছি, পথিমধ্যে দেখলাম রাস্তার দুপাশে পাটখড়ি আর পলিথিন দিয়ে তৈরি ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর, তার ভিতর অজস্র মানুষ, এ যেন ক্যান্ডি ভর্তি একটি কোটা। বাস্তবে এখানকার লোকগুলো বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী। শরণার্থী ক্যাম্পের মাঝখান দিয়ে আমাদের গাড়িটা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। স্পিড বেশী দেওয়া যাচ্ছেনা এইজন্য যে রাস্তাতেও অজস্র লোক গিজগিজ করছে, যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া ছোট সুটকেসটা তখনো আমার সাথে। মনে হল সুটকেসটা রাস্তায় চলার পথে একটা অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমার সমস্ত জিনিসপত্র ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে সুটকেসটি বাইরে ধরতেই শকুনের মত কে যেন ছিনিয়ে নিল, হয়তো তার ভিতর মহামূল্যবান সম্পদ আছে এই আশায়।
১৬ই মে, ২০২০
আজ এখানেই শেষ
coppy from FB ID
Some memories of independence 11 of Mokhlesur Rahman |
অবশেষে এক সপ্তাহ বা তার একটু অধিক সময় বারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে কাটানোর পর এক সন্ধায় ডিনার শেষে আমাদের ডাক আসল কেন্দ্রীয় অফিস থেকে। এখানে কেন্দ্রীয় অফিস বলতে একই ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে অবস্থিত ছাত্র নেতাদের কার্যালয়ের কথা বলা হচ্ছে। মেহেরপুর এবং গাংনী থানার বাসিন্দাদেরকে একই সাথে জড় হওয়ার জন্য বলা হল। কি উদ্দেশে ডাকা হচ্ছে, সেটা স্পষ্ট না হলেও কিছুটা অনুমান করতে পারছিলাম। এছাড়া ছাত্রনেতাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল বড় ভাই-ছোট ভাইদের মত। আমরা আমাদের সুবিধা অসুবিধা সবকিছুই অনায়াসে তাদেরকে বলতে পারতাম।
আমাদেরকে বলা হল ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানের সময় ঘনিয়ে এসেছে। পরদিন সকাল থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কাজের সুবিধার জন্য টীম তৈরি করা হল। সংগঠিত বাহিনীর অনুরুপ না হলেও আমাদের চেইন অব কমান্ড থাকার প্রয়োজন। আমাদের টীম লিডারের দায়িত্ব দেওয়া হল করমদি গ্রামের গোসায়ডুবি পাড়ার মোফাজ্জেল হোসেন কে। কারন উনি ছিলেন আমাদের সকলের বয়োজ্যেষ্ঠ, এবং শিক্ষার দিক থেকেও এগিয়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই উনি মেহেরপুর কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। আর আমরা সকলেই এস এস সির পরীক্ষার্থী অথবা তার আশে পাশে। আর আমাকে সহলিডার বানানো হল। প্রকৃতপক্ষে আমার চেয়ে বয়সে বড় এমন দুইএকজন ছিল, যেমন করমদি গ্রামের আব্দুল কাদের, কাজিপুরের আশরাফ ভাই, মিনাপাড়ার মকবুল হোসেন। আর মিনাপাড়ার আশরাফুল ছিল সর্বকনিষ্ঠ, সে তখন মেহেরপুর হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। বয়স কম হলেও তার শারীরিক গঠন ছিল খুবই চমৎকার, পাতলা হালকা, লম্বা, খুবই ফরসা। কেন যেন অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।
যদিও আমাদের নিজ নিজ এলাকায় কাজ করার জন্য বলা হল, কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য নিম্নতম কিছু অস্ত্র আমাদেরকে দেওয়া হল। টীম লিডারের জন্য এস এল আর, আর আমাদের জন্য থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও কিছু গুলি, কতগুলো গুলি দেওয়া হয়েছিল সংখ্যাটি মনে নাই, তবে খুব বেশিও নয়। এছাড়া আমাদের প্রত্যেককে দুটি করে হ্যান্ড গ্রেনেড, ছোট খাট ব্রীজ বা বিল্ডিং ভাঙ্গার জন্য কিছু ডেটোনেটার এবং এক্সপ্লোসিভ। এগুলোর ব্যাবহার কখনই হয় নাই।
এপর্যন্ত আমরা এক্যাম্প থেকে ওক্যাম্পে গিয়েছি, সব জায়গাতেই আমাদের জন্য খাবার, বিছানা, কাপড় চোপড়, গোসলের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যাবস্থা ছিল। কিন্ত এখন থেকে আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেটা সম্পূর্ণ অজানা। শুধু তাই নয়, অতি বিপদকে সামনে নিয়ে। বিপদই যেন আমাদের নিত্য সঙ্গী। যেকোন সময় যেকোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কয়েনের এপিঠ আর ওপিঠ। আমাদেরকে কিছু নগদ টাকা দেওয়া হল। আমরা যেন অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে থাকি, না খেয়ে থাকি সেজন্য। আবার খুধা নিবারনের জন্য কাউকে যেন পীড়া না দিই সে সাবধান বানিও বারবার শুনানো হল।
আমরা পরদিন দুপুরের পর বারাকপুর থেকে রওয়ানা দিলাম, বাস না ট্রাক, আমার মনে নাই। জন্মভুমিকে স্বাধীন করার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা। কিন্তু কোথায় যাব, কিভাবে যাব, কার সাথে যাব, সবই অনিশ্চিত। কোথায় যাচ্ছি বলা হলনা। আমাদের নিরাপত্তার জন্য এধরনের গোপনীয়তা। আমাদের অবস্থান সম্পর্কে শত্রু পক্ষ আগে থেকে জেনে গেলে নির্ঘাত আমাদের মৃত্যু। আমাদের সবাইকে একটা করে ব্যাকপ্যাক দেওয়া হল যার মধ্যে নিজস্ব কাপড় চোপড় ছাড়াও দুটি করে হ্যান্ড গ্রেনেড, গুলি বারুদ নেওয়ার জন্য। রাইফেলটি কাঁধে ঝুলিয়ে। আমরা যাচ্ছি তো যাচ্ছি, পথিমধ্যে দেখলাম রাস্তার দুপাশে পাটখড়ি আর পলিথিন দিয়ে তৈরি ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর, তার ভিতর অজস্র মানুষ, এ যেন ক্যান্ডি ভর্তি একটি কোটা। বাস্তবে এখানকার লোকগুলো বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী। শরণার্থী ক্যাম্পের মাঝখান দিয়ে আমাদের গাড়িটা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। স্পিড বেশী দেওয়া যাচ্ছেনা এইজন্য যে রাস্তাতেও অজস্র লোক গিজগিজ করছে, যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া ছোট সুটকেসটা তখনো আমার সাথে। মনে হল সুটকেসটা রাস্তায় চলার পথে একটা অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমার সমস্ত জিনিসপত্র ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে সুটকেসটি বাইরে ধরতেই শকুনের মত কে যেন ছিনিয়ে নিল, হয়তো তার ভিতর মহামূল্যবান সম্পদ আছে এই আশায়।
১৬ই মে, ২০২০
আজ এখানেই শেষ
coppy from FB ID
No comments