স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১২ : ঐ দেখা যায় বাংলাদেশ
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১২
ঐ দেখা যায় বাংলাদেশ
আমাদের গাড়িটা (আমি গাড়ী শব্দটা ব্যাবহার করছি এজন্য যে আমাদের বাহনটি বাস না ট্রাক সেটা অস্পষ্ট) কৃষ্ণনগর থেকে তেহট্ট হয়ে বেতাইয়ের দিকে যাচ্ছিল। তেহট্ট থানার কোন এক জায়গাই আমাদেরকে নামিয়ে দেওয়া হল। সেখান থেকে নৌকায় পাড়ি দিতে হবে। ৬০এর দশকের পূর্বে যাদের জন্ম, তাদের হয়তো স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৭১ সালে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। আবাদি জমিগুলো তো বটেই, রাস্তা ঘাটগুলোও ছিল পানির নীচে। কোনটা নদী আর কোনটা ধানী জমি, পার্থক্য করা খুবই মুশকিল ছিল।
আগে থেকেই নির্ধারণ করা ছিল এমন একটা নৌকাতে আমরা চেপে বসলাম। নৌকাটি কে ভাড়া করে রেখেছিল, ভাড়াই বা কে দিয়েছিল, সবই আমাদের অগোচরে। আমরা নৌকায় উঠলাম তখন হয়তো রাত্রি ১০টার কাছাকাছি। যতদুর চোখ যায় পানি আর পানি। মানুষের বাসালয় বা লোকালয় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। নৌকার মাঝির নিকট নিশ্চয়ই জিপিএস ছিলনা, তবুও সে যেন অতি আত্মবিশ্বাসে আমাদেরকে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের গন্তব্যস্থল নিশ্চয় ভুল হবে না। আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা জেনেও আমাদের কোন লাভ ছিলনা, কারন ঐ অঞ্চলের কোথায় কি আছে সে সম্পর্কে আমাদের আদৌ কোন ধারনা ছিলনা। মাঝিকে বিশ্বাস করেই আমাদের অগ্রসর। হয়তো হতে পারে ঐ মাঝি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের মতন মুক্তিযোদ্ধার বাচ্চাগুলোকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছিয়ে দেওয়াটাই তার কাজ। চারিদিকে নেই কোন শব্দ। শুধু মাঝির বৈঠার সপাৎ সপাৎ শব্দই শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছিল আমরা থেমে নেই, এযেন অনন্ত চলা।
রাতটা ছিল পূর্ণিমার। জুলাই মাসের কোন এক সময়। আকাশে ধুলাবালির কোন কনা খুঁজে পাওয়া যাবেনা। পূর্ণিমার চাঁদ আর উজ্জ্বল তারাতে ভরপুর ছিল আকাশ। চাঁদ তারার নির্মল জ্যোতি পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে, আর পানির ঢেউয়ের সাথে সেই প্রতিফলনে তৈরি হচ্ছে হিরা কাটার ঝকঝকে স্ফুলিঙ্গ। এযেন মন মাতয়ারার মোক্ষম মুহূর্ত। রোমাঞ্চ অনুভব করার বয়স তখন না হলেও যুবক হতে বাকী ছিলনা। আমি বাংলাদেশে থাকাকালিন কখনো হিরা কাটা দেখিনাই, প্রথম দেখেছি ব্যাংকক, থাইল্যান্ডে। তখনও চশমা পরার মত চোখের অবস্থা তৈরি হয় নাই। নৌকায় যারা আছি তাদেরকে তো বটেই, অনেক দূর পর্যন্ত চোখ যায়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সর্বোত্তম ক্ষণ। আমরা যেন ঢেউহীন কোন এক সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছি। আসলে তখনো আমি সমুদ্র দেখিনাই। সমুদ্রের কি রুপ, কেমনই বা ঢেউ, কি-ই বা রঙ, কিছুই জানা ছিল না। মনে পড়লো কেন রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহের স্বহস্তে স্কেচ করা বাসা ফেলে রেখে নদীর বুকে বার বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছিলেন। এমন রোমাঞ্চকর সময় কাটাতে কাটাতে কখন যে সকাল হয়ে এসেছে সেদিকে আমাদের কোন নজরই ছিলনা।
আমরা এসে ভিড়লাম তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার সর্ব দক্ষিনের গ্রাম আনন্দবাসে। ঐ গ্রামেরই এক যুবক এগিয়ে এলো আমাদের সাহায্য করার জন্য। আমাদের কি লাগবে, কোথায় যাব, কোথায় থাকবো ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। প্রথমেই আমাদের প্রয়োজন কিছু খাবারের, খুব দ্রুত। কখন খেয়েছি, মনে নাই। ক্ষুধায় পেট চোঁচোঁ করছে। গ্রামের মানুষ আমাদের খাবারের আয়োজন করতে চাই, কিন্তু আমরা সেটা নিতে রাজী নই। কারন তখনও আমাদেরকে দেওয়া টাকার একটি পয়সাও খরচ করিনাই। আমরা কিছু টাকা একজনের হাতে দিয়ে কিছু চাল, ডাল আর ডিম কিনে নিয়ে এসে রান্না করার জন্য অনুরোধ করলাম। সমস্যা হল রান্নার কাঠের। গ্রামের কৃষকের বাড়ির সমস্ত জ্বালানি কাঠ ভিজা, রান্নার অনুপযোগী, তবুও কেউ কেউ এগিয়ে এলো আমাদের রান্না করে দিবে বলে। শেষ পর্যন্ত রান্না হল এবং আমরা অতি তৃপ্তির সাথে খেলাম। আমাদের অনিহা সত্তেও সেদিন রাত্রের খাবা্রের যোগান দিয়েছিল গ্রামের লোকজন। সেইসাথে আমাদের রাত্রি যাপনের জন্য বিছানাপত্রও দিয়েছিল। আমরা গ্রামের লোকজনের আথিথেয়তাই মুগ্ধ হয়েছিলাম, সেইসাথে বিশ্বাস জন্মেছিল যে এই লোকগুলো কখনই আমাদের ক্ষতি করতে পারেনা।
সেদিন যে ব্যাক্তিটা আমাদের বিভিন্ন কাজে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছিলেন শুনেছি সেই ব্যাক্তিটাই পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি নাকি উপজিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। আর তাঁর নাম হল জনাব জিয়া উদ্দিন বিশ্বাস। এখানে আরেকটু যোগ করতে চাই। কাকতালিয়ভাবে ঐ গ্রামেরই একজন মহিলা সন্ধানী হাসপাতালে নার্স হিসাবে কাজ করেছেন। আমি অনেকবার ভেবেছি আনন্দবাসে একবার যেয়ে সেই সময়ের লোকজনের সাথে কথা বলি, আমাদের কথা তাদের মনে আছে কিনা জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু কেন যেন হয়ে উঠে নাই, আর কোন দিন হবে কিনা সেটাও জানিনা।
আমাদের চোখে আনন্দবাস সেদিন কিভাবে ধরা দিয়েছিল? স্বাধীন না পরাধীন? হয়তো কোনটাই নয়। কারন বর্ডারের গ্রাম হিসাবে এই এলাকায় পাক বাহিনীর আসার সম্ভাবনা যদিও খুবই কম, তবু সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করা যায়না। গ্রামের মানুষ আমাদেরকে আপ্যায়ন করতে চাই, কিন্তু কোথায় যেন ভয় কাজ করে। সেদিন মনে হয়েছিল এবং প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই আধা স্বাধীন দেশকে পুরাপুরি স্বাধীন করতেই হবে। যে আশা নিয়ে একদিন করমদি গ্রাম ত্যাগ করেছিলাম, সেই আশার বাস্তবায়ন এই আনন্দবাস গ্রাম থেকেই শুরু।
১৭ই মে, ২০২০
আজ এখানেই শেষ
Coppy from FB ID
Good...thanks
ReplyDelete