স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১০

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১০

বিদায়, দেরাদুন
সম্ভবত জুলাই মাসের কোন এক সময়। এবার দেরাদুন থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। দেরাদুনে কতদিন ছিলাম, সঠিক মনে নাই। তবে এক মাসের একটু বেশী হবে বলে মনে হয়। ইতিমধ্যে পাহাড় কুঞ্জের বন জঙ্গলে, গাছপালায়, আকাশে শরৎ উঁকি দেওয়া শুরু করেছে। গাছের পাতার রঙ্গের পরিবর্তন যেমন এসেছে, তেমনি তাপমাত্রার পরিবর্তনও লক্ষণীয়। যদিও পাহাড় থেকে নেমে এলে ভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। শরৎ আসতে তখন আরও অনেক দেরী।  

সকাল বেলায় নাশতা শেষ করে, বিছানাপত্র ভাঁজ করে মিলিটারি ট্রাকে উঠার প্রস্তুতি। আমাদের পরের ব্যাচের ট্রেনিং গ্রহণকারীরা বিদায়ী ছালাম জানাতে এলো। তাদের মুখে যেন মলিনতা। অনেকেই হোম সিকে ভুগছে। কবে এখান থেকে বিদায় নিব, দেশে ফিরে যাব, বাবা মার সাথে দেখা হবে, সবার একই আকুতি। আমাদের ওস্তাদদের থেকেও বিদায় নিয়ে অপেক্ষমান ট্রাকে উঠলাম। আবারো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা। বমির ভয়ে অনেকেই সকালের নাস্তা খাই নাই। গাড়ীর চাকা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো। 

পাহাড়ধ্বসের জায়গায় এসে ট্রাকটি থেমে গেল। ট্রাক আর সামনের দিকে যাবেনা। ভেঙ্গে যাওয়া রাস্তাটুকুন পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু এবার আগের মত অপেক্ষমান ট্রাক এখনও এসে পৌছাই নাই। কোন কারনবশত ট্রাক আসতে দেরী হয়েছে। আমরা ট্রাক থেকে নেমে ঝর্নার কিনারে যেয়ে ঠাণ্ডা পানিতে খেলা শুরু করলাম। ছোট ছোট পাথরগুঁড়ি দিয়ে পানিতে ব্যাঙ ঝাপ খেলা। হয়তো এখেলার কথা অনেকেরই মনে আছে। আমাদের এক বন্ধু হঠাৎ করেই উপর থেকে নেমে আসা পানির মধ্যে নরনারীর ডেটিং স্পট আবিষ্কার করলো।  বিষয়টা নিম্নরূপ। পাহাড়ের উপর দিক থেকে দ্রুত পানি নেমে আসছে। নীচের এক জায়গায় অনেক বড় একটা পাথর, হয়তো কয়েকশ টন হবে। উপর থেকে পানি এসে বড় পাথরের সাথে আলিঙ্গন করে অনেক দূরে যেয়ে পড়ছে। এ যেন লংজাম্প। পাথরের নীচের অংশ এবং পানি যেখানে পড়ছে তার মধ্যে একটা শুন্যতা তৈরি হচ্ছে। ওই শুন্য জায়গাই ঢোকার জন্য দরজা বিহিন সরু গলি তৈরি হয়ে আছে। সেখান দিয়ে অনায়াসে ২জন মানুষ ভিতরে প্রবেশ করে ফাঁকা জায়গায় বসতে পারবে। ঝর্নার পানি কোন ভাবেই তাদেরকে স্পর্শ করতে পারবে না। এ যেন প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য স্বয়ং বিধাতাই এমন একটি মনোরম স্পট প্রাকৃতিক ভাবেই তৈরি করে রেখেছে। কি সাংঘাতিক রোমাঞ্চকর জায়গা। ইতিমধ্যে আমাদের গাড়ী এসে গেছে। এমন সুন্দর জায়গাটি থেকে বিদায় নিলাম।   

আমাদেরকে নিয়ে আসা হল একটা বিমানবন্দরে, নামটি জানিনা। একই মুড়ির টিনের প্লেনে উঠলাম এবং নামলাম কোলকাতার দমদম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। তখন কিছুটা রাত হয়ে গেছে। বিমানবন্দরের যে জায়গায় আমাদেরকে নামানো হয়েছিল, সেটি হয়তো সাধারন যাত্রীদের জন্য নয়। ওয়েটিং রুমে যেয়ে টয়লেট খুঁজে পেতে কষ্ট হল। কিছু সময় পর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল বারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে আমাদেরকে রিসিভ করলো কয়েকজন ছাত্র নেতা। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা আছে, সেই সাথে খাবারেরও। 

এই ক্যাম্পের বিভিন্ন দায়িত্তে থাকা লোকগুলো যেন একটু ভিন্ন মনে হচ্ছিল। পরে জানতে পারলাম এরা গোর্খা জাতি। লম্বাই খাট, শরীরের রঙ ফর্শা, নাকগুলো বোঁচা, খুবই শক্তিশালী। ইন্ডিয়ান হলেও তারা মঙ্গল রেসের। তাছাড়া এরা নাকি খুব প্রভুভক্ত হয়। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এরা সৈনিকের দায়িত্তে। ভারত উপমহাদেশ স্বাধীন হও্য়ার পরও তারা ব্রিটিশ আর্মিতে চাকুরি করে। আমার একজন নেপালি ছাত্রির বাবা গোর্খা এবং সেও ব্রিটিশ আর্মির সেনা। আমাদের খাবার দাবার, নিরাপত্তা সবকিছুর দায়িত্ত তারাই পালন করত।  

ছাত্র নেতাদের অফিস ছিল এই ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে একটা ঘরে। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর ছাত্র নেতাদের সাথে আমাদের মিটিং হত। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আমাদের সুবিধা অসুবিধা ইত্যাদি ছিল মেইন টপিক। 

আমাদের ৩ বেলা খাবার দেওয়া হতো। আমরা লাইন ধরে টিনের প্লেট হাতে নিয়ে সারি দিয়ে দাঁড়াতাম। বর্ষার সময়। আমাদের বিল্ডিং থেকে ডাইনিংয়ে যাওয়ার পথটি পানিতে ডুবে গেছে। পায়ের নীচে অন্তত ১০ ইঞ্চি পানে জমে আছে। আমরা যেন জুতা পায়ে দিয়ে যেতে পারি তার জন্য মাঝে মাঝে ২ টা করে ইট বিছানো আছে। মেনু হচ্ছে ভাত, ডাল এবং একটা সবজি। ডাল দিতে কোন কার্পণ্যতা ছিল না। আমরা একটু বেশী করে ডাল নিতাম। একেবারে প্লেটের কানায় কানায় ভর্তি করে। ডাল ভর্তি করে নিলে উপরে ভেসে উঠত বিভিন্ন রঙয়ের, বিভিন্ন আকারের পোকা। প্লেটটি কাত করে উপরে ভেসে উঠা পোকা গুলোকে ফেলে দিয়ে অবশিষ্ট অংশটুকুন খেয়ে নিতাম। আর ভাতের ভিতর সাদা রঙয়ের পাথর। মুখের ভিতর খচ করে উঠত। এভাবেই কাটলো আনুমানিক দুসপ্তাহ।      
 
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৬    মুক্তিযুদ্ধের মিশন (mission) পর্যালোচনা এবং কর্মপরিকল্পনা নির্ধারন
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি 10

মুক্তিযুদ্ধের মিশন (mission) পর্যালোচনা এবং কর্মপরিকল্পনা নির্ধারন

৫ই মে, ২০২০  

আজ এখানেই শেষ
copyright 

Coppy from, FB ID

No comments

Powered by Blogger.