স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৩ : ডাক দেয় ঐ ঐতিহাসিক আম বাগান

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৩

ডাক দেয় ঐ ঐতিহাসিক আম বাগান

আমাদের গন্তব্যস্থল হল নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়া। কিন্তু কিভাবে যাব? মেহেরপুর শহর ভেদ করে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নাই। আসলে উপায় নাই বলা ঠিক হবেনা, বাস্তবতা হল আমাদের জানা ছিলনা। বিপদ সর্বদা আমাদেরকে ঘিরে রয়েছে, এটা চরম সত্য। এক পা সামনে এগুনো অর্থ কুটকুটে অন্ধকারের মধ্যে নিজকে বিসর্জন দেওয়া। আর সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেই তো এ পথ বেছে নেওয়া। বিপদ আসবে, সেই বিপদকে জয় করতে হবে, সেটাই তো একজন দেশপ্রেমিকের ব্রত। কারোর চাপে তো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই নাই, বা টাকার বিনিময়ে বেতনভুক্ত কর্মচারী হয়েও নয়, তাই কিসের এত ভয়? চুপচাপ বসে থাকা যায়না। সামনের দিকে অবশ্যই এগুতে হবে। সেজন্য পথ খুঁজতে হবে। একটা না হলে আরেকটা পথ আবিষ্কার করতে হবে। বৈদ্যনাথতলা গ্রামের মানুষ অন্তর দিয়ে প্রমান করেছে এবং বলেছে,  “যাও বাবা, তোমরা সামনে এগিয়ে যাও, আমরা সর্বদা তোমাদের সাথে আছি”। 
 “ মহা - বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত ” কাজী নজরুল ইসলাম 

  আমাদের সহকর্মীর একজন ঐ এলাকার মানুষ। যতদুর মনে পড়ে তার নাম জহুরুল হক। তার সাহায্য নেওয়া খুবই প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত আমাদের টীম লিডারের কলেজ বন্ধু জনাব নজরুল ইসলাম ও একই এলাকার মানুষ। আশ্চর্যজনকভাবে জহুরুল এবং নজরুল সাহেব মামাত ফুফাত ভাই। তাদের বাড়ি বর্তমান মুজিবনগর থানার অদুরে রামনগর গ্রামে। সিদ্ধান্ত হল আমরা প্রথমে নজরুল সাহেবদের বাড়িতে একরাত আশ্রয় নিব। প্রস্তুতি শুরু হল।  
না জেনে না শুনে গোটা টীম নিয়ে কোথাও অজানা জায়গায় যাওয়া মানে হল সবাইকে জলন্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে ফেলে দেওয়া, গ্রুপ সুইসাইড। অবশ্যই এধরনের ঘটনা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আর এ দায়িত্বটা হল টীম লিডারের। একমাত্র টীম লিডারের সিদ্ধান্তই টীম মেম্বারদেরকে বাঁচতে মরতে সাহায্য করতে পারে। কোন অভিযান করার পূর্বে প্রয়োজন হল সঠিক রেকি করা। রেকি অর্থ হল পূর্বেই গোপনে সরজমিনে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা। নিরাপদ রাস্তা খুঁজে বের করা। রেকির দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবে এলো জহুরুল এবং আমার ঘাড়ে।     

আমরা দুজনে রামনগরের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। দুপুরের একটু আগে। আমাদের যেতে হবে বৈদ্যনাথতলার (পরবর্তীতে মুজিবনগর নামকরন) আমবাগানের ভিতর দিয়ে। আনন্দবাস থেকে বৈদ্যনাথতলার দূরত্ব আনুমানিক ২ কিলো। যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই আমগাছগুলো সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো। শুনেছি আমগাছগুলোর গোড়ার মাটি দারজিলিং থেকে নিয়ে আসা। হয়তো সত্যি নাও হতে পারে। বৈদ্যনাথতলার নিকটবর্তী গ্রাম মানিকনগর। গ্রামটির পাশ দিয়ে একটি নদী বয়ে গেছে। নদী ঠিক বলা যায়না, এটি সরস্বতী খাল। কেন সরস্বতী নাম রাখা হয়েছে তা আমাদের অজানা। এই এলাকায় অনেক ধনাঢ্য হিন্দু লোকের বসবাস ছিল, সেজন্যই কি এই নামকরন? আর এই নদীর পাড়েই পাকবাহিনির আর্মি ক্যাম্প। আমরা জানতে পেলাম আমাদের পৌঁছানোর কয়েকদিন পূর্বে ঐ ক্যাম্পটিকে গুটিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এই ক্যাম্পটি কেন বৈদ্যনাথতলায় না করে মানিকনগরে করা হয়েছে, তারও ব্যাখ্যা দরকার। আমরা জানি বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশের অস্থায়ী মন্ত্রী পরিষদ তৈরি হয়েছিল এবং উপস্থিত ব্যাক্তিবর্গের অনেকেই ভারত থেকে এসেছিলেন। প্রতিশোধ নেওয়াটাই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে আর্মি ক্যাম্পটি বৈদ্যনাথতলায় স্থাপন করাটাই যুক্তিসঙ্গত। যেহেতু বৈদ্যনাথতলা গ্রামটি একেবারেই বর্ডারে অবস্থিত, পাক বাহিনীর জন্য এখানে অবস্থান করা মিলিটারি কৌশলের বহির্ভূত। সেজন্যই হয়তো বৈদ্যনাথতলার পরিবর্তে বর্ডার থেকে কয়েক কিলো দূরে এই মানিকনগর কে বেছে নেওয়া হয়েছিল।  
বৈদ্যনাথতলায় হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেল কয়েকজন যুবকের সাথে। জহুরুল তাদের কয়েকজনকে চিনত। এরা ঐ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা। ভালুই হল। তাদের সাথে কথা হল। আমরা যে কোন সময় ঐ অঞ্চল দিয়ে পাড়ি দিতে পারি সেটা জানালাম। সেইসাথে আমাদের পাসওয়ার্ড টিও। আমরা শত্রু পক্ষ না মিত্র পক্ষ সেটা এই পাসওয়ার্ডের মাধ্যমেই একে অপরকে সনাক্ত এবং নিশ্চিত হব।  

আমরা বিকালবেলায় রামনগরে জহুরুলের মামার, অর্থাৎ নজরুল সাহেবদের বাড়িতে এসে পৌছালাম। তারা সবাই আমাদেরকে দেখে খুব আশ্চর্য। কারন জহুরুল যে দেশে ফিরেছে এটা তাদের তখনও জানা ছিলনা। আমাদের ভ্রমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানালাম এবং তারা আমাদেরকে খুব আগ্রহের সাথে গ্রহন করার অনুমতি দিলেন। সেখানে নজরুল সাহেবের সাথে দেখা হল। পরবর্তীতে নজরুল সাহেব কেদারগঞ্জ হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। সম্ভবত বছর দশেক আগে বল্লভপুর মিশন হাসপাতালে যাওয়ার পথে কেদারগঞ্জ হাইস্কুলে নজরুল সাহেবের সাথে দেখা হয়েছিল। তারও কয়েক বছর পর, মুজিবনগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সহ নজরুল সাহেব এসেছিলেন বল্লভপুর মিশন হাসপাতালে আমাদের সাথে দেখা করার জন্য। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় আমাকে লক্ষ্য করে উনার প্রথম কথাটি ছিল,  “দেখ, সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাকে ”। খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।  

আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে একই দিনের বিকাল বেলায় আবারো রওয়ানা দিলাম আনন্দবাসের দিকে। সন্ধায় সেখানে পৌঁছিয়ে রাত্রিতে আনন্দবাস থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। 
রাত্রি ১০ টার দিকে আমরা বৈদ্যনাথতলা থেকে বিদায় নিলাম। পুরা রাস্তাটি ছিল কর্দমাক্ত, তাই জুতা পায়ে দিয়ে নয়, হাতে নিয়ে। রাস্তায় তেমন কোন অসুবিধা হলনা। সম্ভবত রাত্রি ১২ টার দিকে আমরা রামনগরের নজরুল সাহেবদের বাড়িতে পৌছালাম। যেহেতু নগ্ন পায়ে এসেছি, এবং পথিমধ্যে আমাদের কয়েকজন পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল, তাই তাদের কাপড় ধোয়া এবং গোসলের প্রয়োজন। নজরুল সাহেবদের বাড়ি সংলগ্ন সিঁড়ি বাঁধা ঘাট, আমরা সেখানে গোসলে নামব, সেই সাথে আমাদের রাইফেল গুলোও পরিষ্কার করে নিব ভাবছি, ঠিক সেসময় আবিস্কার হল আমাদের টীমলিডারের এস এল আরের ম্যাগাজিনটা নাই। রাইফেলে যদি ম্যাগাজিন না থাকে, তাহলে এই অস্ত্রটি লাঠির চেয়েও অকেজো। ম্যাগাজিনটা রাস্তায় কোথাও পড়ে আছে কিনা খোঁজার জন্য টীমলিডার তাতক্ষনিক বের হওয়ার উপক্রম। নজরুল সাহেবের আব্বা আমাদের এহেন পরিস্তিতি সম্পর্কে জানতে পেরে আমাদেরকে আশ্বস্ত করলেন এবং বললেন, তোমাদের যাওয়া লাগবে না, আমি ব্যবস্থা করছি। তিনি সূর্য মামা ঘুম থেকে উঠার আগেই একজন লোক পাঠিয়েছিলেন। রাস্তার ঠিক মাঝখানে কাদার উপর ম্যাগাজিনটি তার প্রেমিকের জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। সেবারের মত বেঁচে গেলাম। সবাই কান ডলা দিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম একই ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।   

স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৩ : ডাক দেয় ঐ ঐতিহাসিক আম বাগান
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৩ : ডাক দেয় ঐ ঐতিহাসিক আম বাগান

 ১৮ই মে, ২০২০   

আজ এখানেই শেষ
Coppy from FB ID

No comments

Powered by Blogger.