স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৪ : আবারো ভারতের মাটিতে পদার্পণ
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৪
আবারো ভারতের মাটিতে পদার্পণ
রামনগর থেকে মেহেরপুর অতিক্রম করে গাংনীর নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার রাস্তাটিকে নিরাপদ মনে হলনা। কারন মেহেরপুর কলেজ, ভাটপাড়া, এবং বামনদীতে পাকবাহিনীর ক্যাম্প। এগূলো অতিক্রম করা সহজ নয়। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম আবারো ভারতে ফিরে যেয়ে আমাদের নিকটতম বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করাটাই হবে উত্তম। আমরা রামনগরে এক রাত যাপন করে পরদিন রাত্রি বেলায় দারিয়াপুরে আশ্রয় নিলাম। এব্যাপারে কে সহযোগিতা করেছিল, মনে করতে পারছি না। তবে হয়তো এমন হতে পারে একজন রাজনৈতিক নেতা আমাদের অগোচরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে ঐ গ্রামে মেহেরপুরের একজন বড় নেতা ছিলেন, হাজী ইদ্রিস। তাঁর সরাররি সহযোগিতা ছিল কিনা অদ্যাবধি জানিনা। স্বাধীনতার পর অনেকবার তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছে কিন্তু কখনই এপ্রসঙ্গ উঠে আসে নাই। দারিয়াপুরে কার বাড়িতে ছিলাম, আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা কে করেছিল, বয়সের ভারিক্কীতে সবই ভুলে গেছি।
দারিয়াপুর থেকে আমরা ভারতের বেতাইয়ের কোন এক জায়গায় যাব। কোন রাস্তা নাই। আবারো পানিপথে যেতে হবে। স্থানীয় এক ব্যাক্তি আমাদেরকে গাইড করল। এবারও জুতাজোড়া হাতে। লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে। হাঁটু পানির মধ্যে প্রায় এক কিলো হেঁটে যাওয়ার পর নৌকা স্টেশন। সেখানে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলাম নৌকার জন্য। অচেনা পানির মধ্যে হাঁটা খুব সহজ কাজ নয়। সেইসাথে পিঠে আছে অন্তত ১৫ কিলোর বোঝা। একটু পা পীছলালেই পানি কাদার সাথে হয়ে যাবে আলিঙ্গন। নিজে তো ভিজে যাবই, সেইসাথে কাপড় চোপড় এবং আত্মরক্ষার সামগ্রীও। বিশেষ করে অস্ত্রগূলো ভিজে গেলে পুনরায় ব্যাবহার করা কঠিন হবে। আমাদের জন্য বিশেষ ভাবে ভাড়া করা কোন নৌকা নাই। সাধারন যাত্রীদের সাথে আমরা একটা নৌকায় উঠে বসলাম। নৌকা ভিড়লো বেতাই থানার কোন এক জায়গায়। সেখান থেকে আমরা শিকারপুর যাব। আমাদের কাঁধে ঝুলানো আছে রাইফেল। এই অস্ত্রটা দেখে কোন বাস বা ট্রাক ড্রাইভার কেউই আমাদেরকে নিতে চাইছিল না।
আকস্মিকভাবে লক্ষ্য করলাম রাস্তার পাশে একটা নর্দমাতে (পুকুরে) মেহেরপুরের এম এন এ জনাব ছহিউদ্দিন সাহেব গোসল করতে এসেছেন, সেইসাথে কিছু কাপড় চোপড় নিয়ে এসেছেন ধোয়ার জন্য। আমরা ছহিউদ্দিন সাহেবের সাহায্য কামনা করলাম। ছহিউদ্দিন সাহেব হচ্ছেন বর্তমান উপমন্ত্রি এবং মেহেরপুর ১ এর এম পি জনাব ফরহাদ সাহেবের পিতা। উনি একটা ট্রাকের ড্রাইভারকে অনুরোধ করলেন আমদেরকে শিকারপুর পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য। শেষপর্যন্ত একটা গতি হল এবং আমরা শিকারপুরে এসে পৌছালাম। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। আমরা আবারো মাথাভাঙ্গা নদীর কিনার বয়ে রওয়ানা দিলাম গ্রামের উদ্দেশে্। রাস্তায় আমরা কোথায় কি খেয়েছি কিছুই মনে নাই। অভুক্ত ছিলাম কিনা সেটাও অনিশ্চিত।
আমি এখনকার তুলনায় ছাত্র জীবনে অনেক পাতলা ছিলাম। আসলে আমি মোটা হতে শুরু করেছি অনার্স ফাইনাল পরিক্ষার আগ থেকে। এক খানা রাইফেল ও ১৫ কেজির ব্যাকপ্যাক বহন করা আমার জন্য ছিল খুবই কষ্টকর। কিন্তু নিজের বোঝা তো নিজেই বহন করতে হবে। আমরা কয়জন মুক্তিযোদ্ধা একদিকে আনন্দে অপরদিকে ভীতিতে শিরদাঁড়া বাঁকা করে শরীরের ঊর্ধ্বাংশ সামনের দিকে ঝুকিয়ে একপা দুপা করে কাদাপানি ভেংগে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। হঠাৎ করেই দেখলাম দুজন ব্যাক্তি আমার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। রাত্রির অন্ধকারে লোক দুজনকে দেখা দেখা মনে হল। জ্যোসনা রাত্রির সামান্য আলোতে আমাদের উভয়ের চোখে চোখ পড়ল। ঠিক সে সময়ই অপর পক্ষ থেকে ভেসে এলো মোখলেছ মামু! আমিও একই সময়ে একই বাক্য উচ্চারন করলাম। আসলে ঐ দুইব্যাক্তি আমাদের বাড়ির পাশের বাসিন্দা অমল মামু আর করিম মামু (সত্যিকারে তাদের নাম হল অমল সর্দার আর করিম সর্দার, দুই সহোদর)। আমাদের গ্রামে আব্দুল আজিজ নামে জনৈক পাক আর্মি ছিল। পাকিস্তানের কোয়েটাতে তার পোস্টিং ছিল, কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ছুটিতে দেশে এসে আর ফিরে যেতে পারে নাই। তাই তার মিলিটারি বিদ্যা বুদ্ধি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ে কাজে লাগানোর জন্য করিমপুর ক্যাম্পে যোগদান। অমল-করিম দুই ভাই আব্দুল আজিজের নিকট নিত্য ব্যাবহারযোগ্য কিছু জিনিস পৌছিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। ঠিক সেসময়েই আমাদের সাথে দেখা। ছোট ভাই অমল সর্দার আমার ব্যাগটা নিয়ে নিল, কিছুটা জোর করেই। করিম সর্দার আমার রাইফেলটা নিতে চাইলো, কিন্ত আমি সেটা দিলাম না। আমরা কাজিপুর হয়ে সাহেবনগর, হাড়াভাঙ্গা, কল্যাণপুর হয়ে করমদি, বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। টীমলিডার মোফাজ্জেল কল্যাণপুরে ভাগ হয়ে চলে গেল তার বাড়িতে। কাদেরের বাড়ি আমাদের পাড়ায়, সেও শেষ পর্যন্ত আমার সাথে এসে বাড়ি চলে গেল। সাথে থাকলো মকবুল, মুছাব এবং আশরাফুল।
আমাদের বাড়ির অন্দর মহলে যাওয়ার আগেই একটা চার চালার বৈঠকখানা ছিল। তিনদিকে বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘেরা। চৌকিটাকে আড়াল করার জন্য সামনের অর্ধেকটা পাটখড়ি দিয়ে ঘেরা। ভিতরে একটা চৌকি, একটা টেবিল, দুইটা চেয়ার, দুইটা লম্বা বেঞ্চ ছিল। আমরা দুইভাই ঐ চৌকিতেই রাত কাটাতাম। আমার পড়াশুনাও ছিল একই ঘরে।
মকবুল, মূছাব এবং আশরাফুল কে বৈঠকখানার সামনে অপেক্ষা করতে বলে বাড়ীর ভিতরে গেলাম। মা বলে ডাকতেই মা তো হাঊমাঊ করে কেঁদে ঊঠলো। হারিকেন ধরানোর চেষ্টা করল। বিদ্যুৎ এসেছে তারও ২০ বছর পর। পাশের ঘরে আমার তিন নম্বর ভাইটি (মোজাফফর) শুয়ে ছিল। সে আবার পাকিস্তান আমলে মিলিশিয়া/ আনসার ট্রেনিং করেছিল। সে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত মার ঘরে এসে বলল, “মা, কেঁদো না, হারিকেন নীভাও।” বাইরের কেঊ যেন টের না পায় সেজন্যই এই সাবধানতা। অন্তত এই সময় তার ট্রেনিংটা কাজে লেগেছিল।
এদিকে বাইরে অপেক্ষারত তিন মুক্তিযোদ্ধা বৈঠকখানার ভিতরে ধাপ বয়ে উঠার বৃথা চেষ্টা করছিল। ঘরের বাইরে ঝাপসা দেখা গেলেও ঘরের ভিতরে কোথায় কী আছে বূঝা মুশকিল। ওরা তিনজন ঘরের ভিতর উঠতে গেলে রাইফেলের ব্যাটের সাথে বেঞ্চের ধাক্কা লাগে এবং শব্দ হয়। ঐ ঘরের মধ্যে আমার বাবা এবং ছোটো ভাই (জাফর) শুয়ে ছিল। বাবার ধারনা নিশ্চয়ই পাকবাহিনী এসেছে। এবার আর রক্ষা নাই। কম্পিত কণ্ঠে আমার বাবা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করল তোমরা কারা? ওদের উত্তর হল, “চাচা, চূপ করেন।” আমার বাবার তো একথা শূনে গলা শুকিয়ে মরুভূমি। সেসময় পাকবাহিনী এবং বিশেষ করে রাজাকাররা দল বেঁধে রাত্রিবেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ী হামলা করত। শেষে ওদের কেঊ একজন জানাল, মোখলেছ ফিরে এসেছে, বাড়ীর ভীতরে গেছে। বাবারও মায়ের মত একই অবস্থা। কয়েকমাস পর জীবন্ত ফিরে আসা ছেলের সাথে মা বাবা, ভাই বোনের পুনঃমিলন। খুশির ফোয়ারা বয়ে যাওয়ার কথা, অথচ সবার মুখেই যেন চাপা ভীতি। ছেলে বাড়িতে থাকার সময়ের চেয়ে না থাকার সময়ের ভীতিটাই যেন প্রকট।
আটচালা ঘরের ঠিক মাঝখানের ঘরটিই হল আমাদের কারাগার।
১৯ই মে, ২০২০
আজ এখানেই শেষ
Coppy from FB ID
No comments