স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৫
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৫
শুরু হল জীবনের নতুন এক অধ্যায়
করিমপুর থেকে বিদায় নেওয়ার সময় যে ঘটনা ঘটেছিল আজও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। যে ব্যক্তিটা আমাদের আদরের সাথে মিষ্টিমুখ করে বিদায় দিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তির অযাচিত আবির্ভাব। পাঠকদের নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না সেই ব্যক্তিটাকে চিনতে। তিনিই হচ্ছেন আ ফ ম ইদ্রিস, করমদি হাইস্কুলের আজীবন প্রধান শিক্ষক, আমার অতি প্রিয়জন, শ্রদ্ধাভাজন। আমরা ভেবেছিলাম যেহেতু আমরা রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফিরেছি, খেয়েছিও কিছুটা গোপনে এবং আধা অন্ধকারে, তাহলে আমাদের উপস্থিতি কিভাবে এই ব্যক্তির কানে পৌছাল? কোনভাবেই এই প্রশ্নের সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলামনা। স্যার কিভাবে আমাদের আগমনের সংবাদ পেয়েছেন জানতে খুব ইচ্ছা করল। তাই আবারো একই প্রশ্ন করলাম। স্যারও একই উত্তর করলেন, “আমি তোমাদের শিক্ষক নই?” আমাদের যে কোন প্রয়োজনে স্যার আমাদের সঙ্গে আছেন, এটাই জানানোর জন্য এসেছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত তাই-ই করেছেন। বুঝতে মোটেই কষ্ট হলনা স্যার তাঁর ছাত্র ছাত্রিদেরকে কত ভালবাসেন এবং মজ্ঞল কামনা করেন।
এতদিনের যে কর্মকাণ্ড, সেগুলো ছিল শুধুমাত্র প্রস্তুতি। এখন থেকে তার বাস্তবায়ন। আমরা অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং নিয়েছি, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা নিয়েছি। সেগুলোর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন কর্ম পরিকল্পনা। আর এখানে ভূল হলে সামনের রাস্তাটি হবে দুর্যোগময়। কিন্তু কীভাবে পরিকল্পনা করতে হয়, সেবিষয়েও আমরা ছিলাম অতি অপরিপক্ক। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমেই মকবুল, আশরাফুল এবং মূছাব কে স্বস্ব বাড়ীতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। দিনগত রাতে আমি সহ ওরা তিনজন মিনাপাড়ার দিকে রওয়ানা দিলাম। আমাদের সাথে আরও কেউ ছিল কিনা স্পষ্ট মনে হচ্ছে না। কোন পথে যাব স্পষ্ট কোন ধারনা নাই। বামন্দিতে পাক আর্মির ক্যাম্প, তাই ওদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। আমরা ভরাট, দুর্লভপূর, জোড়পুকুর, ষোলোটাকা, শিমূলতলা, মিনাপাড়া রুট বেছে নিলাম। এই রুটটী আমার জন্য কিছূটা সুবিধাজনক ছিল। দুর্লভপূরে আমার ফুফুর বাড়ী। আমি ঐ গ্রামে অনেক বার গিয়েছি। রাস্তাঘাটও কিছুটা চিনি। এছাড়া ঐ গ্রামে আমাদের অনেক স্কুল ফ্রেন্ড ছিল। প্রয়োজনে আমরা তাদের সাহায্য নিতে পারব সেই আশা।
করমদি গ্রামের বাঘপাড়া হয়ে ভরাটের রাস্তা। বাঘপাড়া এবং মধ্যমপাড়ার মাঝখানের রাস্তাটি ছিল ভীষণ খারাপ। মহিষের গাড়ীও চলেনা। এক হাঁটু কাদা। একবার ঐ কাদার মধ্যে ঢুকে পড়লে উদ্ধার পাওয়া মুশকিল। তবুও আমরা কিছুটা বাধ্য হয়েই নিরাপত্তার তাগিদে ঐ রাস্তা বেয়ে রওয়ানা দিলাম। ভরাটের গ্রামের ভিতরের রাস্তা তুলনামূলক ভাবে ভাল, খালের পাড় দিয়ে বালিরাস্তা। সমস্যা হল ভরাট দুর্লভপূরের মাঝখানের খাল পাড়ী দেওয়া। তখনও ব্রিজ হয় নাই। আমাদের সাথে গামছা ছিল, সেটাই একমাত্র ভরসা। আর আমাদের ভিতর অপ্রকাশিত সমঝোতা ছিল যে খাল পাড়ী দেওয়ার সময় আমরা পিছন ফিরে তাকাব না। এভাবেই দুর্লভপূরের মাটিতে পা রাখলাম। সেখান থেকে ধানক্ষেত ভেঙ্গে জোড়পুকুরের পথে অগ্রসর হতে লাগলাম। বর্তমান জোড়পুকুর হাইস্কুলের কিঞ্চিৎ আগে বাম দিকে ছিল বিশাল বাঁশ বাগান। এখানে বাড়িঘর বা দোকানপাট তখনও তেমন গজিয়ে ঊঠে নাই। বাঁশ বাগানটি ছিল রাস্তার পূর্বদিকে, তাই সারাদিনেও রাস্তার কাদাপানি কখনো রৈদ্রের মুখ দেখতে পেত না। ঐ রাস্তার উপর দিয়ে ধান পাট বহন করার জন্য প্রতিদিন বহু গরুর গাড়ী, মহিশের গাড়ী চলতো। ফলে রাস্তায় পানি বা কাদা কোনটাই ছিল না। সেখানে ছিল কাল রংগের ঘন দই। আবার কোন কোন জায়গায় এঁটেল মাটির কাদা। মনে হয় এক কোমর হবে। এই কাদা গায়ে লাগলে এক বালতি পানিতেও একখানা পা পরিস্কার করা যায় না। কাদার মধ্যে ঢূকে পড়লে উঠতে পারব কিনা, আবার বাঁশ বাগানের ভিতর কি আছে সেটাও জানিনা। সবচেয়ে বড় বিপদের জায়গা হল বামন্দি-মেহেরপুর রোড পাড়ি দেওয়া। এই রাস্তায় পাক আর্মিরা রাত্রি বেলাতেও টহল দিত। বামন্দিতে তখনো টেলিফোন সংযোগ হয় নাই। পাক আর্মির সাময়িক জরুরী কাজে ব্যবহারের জন্য বামন্দি থেকে গাংনি পর্যন্ত টেলিফোন তার দিয়ে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এটাই ছিল একমাত্র লাইফ লাইন। মুলত পাক আর্মিরা এই টেলিফোন লাইন রক্ষা করার জন্য, সেইসাথে মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তা পাড়ি দিতে যেন না পারে, সেজন্যই এই পাহারার আয়োজন। তাই এখানে সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
যুদ্ধের কৌশল হিসাবে সকলে একইসাথে বিপদের সম্মুখীন হওয়া যাবেনা। ক্ষতি হলে অল্প লোকের উপর দিয়েই যেন হয়। সকলে একসাথে থাকলে সবাই একসাথে ধ্বংস হবে। নিশ্চিত পরাজয়। আমরা এই নিয়ম মেনে একজন মেইন রোডের নিকট, একজন হাইস্কুলের কাছাকাছি, একজন বাঁশ বাগানের মধ্যে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিনজন পাহারা দিবে আর একজন রিস্ক নিয়ে রাস্তা পাড়ি দিবে। একজন পাড়ি দিলে পরেরজন প্রথম জনকে অনুসরণ করবে। সামনের দিকে বিপজ্জনক কিছু দেখলে মুখ বাঁশি দিয়ে পিছনের ব্যাক্তিকে সতর্ক করে দিবে। আমি বিপদে পড়লাম। আসলে আমি ঠোঁট দিয়ে হুইসিল দিতে পারিনা, অনেক চেষ্টা করেও। যাহোক শেষ পর্যন্ত নিরাপদে আমরা রাস্তা পাড়ি দিয়ে ষোলটাকার দিকে রওয়ানা দিলাম। ষোলটাকার পরের গ্রাম সহড়াবেড়ী, মুছাবের গ্রাম। মুছাবের বাড়িতে কোন প্রাচির ছিলনা। আমরা সকলেই একসাথে একেবারে বাড়ির ভিতর। মা বাবা, ভাইবোনের সাথে দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ।
একই ভাবে আমরা গন্তব্যস্থল মিনাপাড়ায় পৌঁছালাম। আশরাফুল হচ্ছে তার বাবা মার প্রথম ছেলে। শুধু তাই-ই নয়, সে ঐ বাড়ির ৫ ভাইয়ের প্রথম ছেলে। এছাড়া সে খুব ভাল ছাত্র। মেহেরপুর হাইস্কুলে পড়াশুনা করত। তাই সে বড় আদরের। অতএব পাঠকগণ বুঝতেই পারছেন ওই পরিবারে তার অবস্থান। ইতিমধ্যে আশরাফুলের সাথে আমার বন্ধুত্ব গাড় হয়েছে। কেন জানিনা আশরাফুলের মা বাবা, চাচা চাচি সবাই আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছেন। সেই সম্পর্ক এখনও আমাদের মধ্যে বজায় আছে, যদিও দেখা সাক্ষাৎ খুব কমই হয়। অনেক সৃতি আছে এই বাড়িকে কেন্দ্র করে।
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ১৫ Our Karamdi village |
২০ শে মে, ২০২০
আজ এখানেই শেষ
Coppy from FB ID
No comments