Some memories of independence 35 Preparation for the oncoming war / Digging trenches in Ramdevpur field/.স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৩৫ সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি / রামদেবপুর মাঠে পরিখা খনন

 স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৩৫  
সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি / রামদেবপুর মাঠে পরিখা খনন 


অক্টোবর শেষ, নভেম্বর মাসের শুরু। মাঠের আমন ধান কাঁটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কৃষকের বউয়েরা নতুন ধানের চাল দিয়ে নিশ্চয়ই নতুন নতুন পিঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেটাই তো বাঙ্গালীর সংস্কৃতি। শীতের দিনে সকাল থেকেই পিঠা বানানোর মহা ধুমধাম, দুপুরের পর পিঠা বানানো শুরু, আর প্রথম পিঠার জন্য শকুনের ন্যায় চেয়ে থাকা আমাদের মত কিছু বুভুক্ষ পথ হারা যুবক। মাস কালাইয়ের ডালের অবশিষ্ট পানিতে ভিজিয়ে নেওয়া ভাত। সে এক ভিন্ন স্বাদ। জাপানে এসে পরিচিত হলাম ওচাজুকে নামক এক খাবারের সাথে। ভাতের মধ্যে গরম পানি ঢেলে তার মধ্যে কিছু শ্যাওলা জাতীয় জিনিষ ঢেলে নিয়ে প্রান ভরে খাওয়া। জাপানে বসেও বাংলাদেশের খাদ্য সংস্কৃতির স্বাদ গ্রহন। পিঠা উৎসবে সদ্য বিবাহিত মেয়ে জামাইয়েরও ডাক পড়ত শ্বশুর বাড়িতে। খাওয়া তো বটেই, সেই সাথে নতুন কাপড় চোপড় ও মিলে যেতো। আসলে সব ক্ষেত্রেই কি তাই হয়? ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় সেই ইচ্ছা পুরন সম্ভব হয় না। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঠিক তেমনটিই ছিল। কখন কি হয়, দুপুরের লাঞ্চ করে সন্ধায় রাতের খাবার কি আমার ভাগ্যে আছে? ছেলে বা ভাই বা পরিবারের কেউ মুক্তিযোদ্ধা হলে তো প্রশ্নই উঠে না। তারা যখন প্রতি নিয়ত মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে, সেখানে তাদেরকে বাদ দিয়ে পিঠা উৎসব, কেন যেন বেমানান।   


এখানে একজন মুক্তিযোদ্ধার ভাইয়ের অনুভুতি সকলে মিলে শেয়ার করতে চাই।  

[১৯৭১ সাল। তখন আমি অনেক ছোট, ৬/৭ বছর বয়স হয়তোবা। আপনি যেসব তথ্য দিলেন আমি এইসব জানিও না বা জানার চেষ্টাও করি নাই কখনোই, আজ জানলাম। আমি এইটুকু জানতাম আমার বড় ভাই মতিয়ার রহমান বাবু মুক্তিফোজে গেছে। বাড়ির বড় ছেলে,‌ মা শুধু কাঁদে ছেলের জন্য, বাবাও হয়ত কাঁদত্,‌‌ দেখি নাই। কখনো কখনো শুনতাম আজ মিলেটারী আসবে। তখন আমরা সবাই ব্রজনাতপুরে (ভারতের একটি গ্রাম, যেখানে শরণার্থী ক্যাম্প বানানো হয়েছিল) চলে যেতাম। আবার বাড়িতে চলে আসতাম। বাবু ভাই হঠাৎ ৩ মাস পর অনেক রাতে বাড়িতে এসেছিলেন শুধু মা আর বাবার সাথে দেখা করে আবার চলে গিয়েছিলেন। তারপর ভাই আসলেন ডিসেম্বরের ১৩/১৪ তারিখের দিকে। আমার খুব গর্ব হয়, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার ভাই। এই দেশ আমার ভাই-ও স্বাধীন করেছেন।] (মুস্তাফিজুর রহমান )   

 

যে ছেলেটি ৩ মাস পর গভীর রাত্রিতে বাড়ির আঙ্গিনায় পা রাখল শুধুমাত্র বাবা মাকে এক পলক দেখার জন্য এবং সেই রাতেই আবারো বিদায় নিল, তখন তার মনের অবস্থা কেমন ছিল? যে বাবা মা নিজের ছেলেকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে সুখের কান্না কেঁদেছিল, ঠিক কয়েক মুহূর্তের ব্যাবধানে আবারো দুঃখের কান্নায় চোখ দুটো ভরে গিয়েছিল। মা কি বাবুকে তার পছন্দের তরকারি দিয়ে ভাত দিতে পেরেছিল? শুধুমাত্র বাইরের দিকই নয়, মায়ের হৃৎপিণ্ডের উঠা নামা কি পরিমানে বেড়েছিল, কেই-ই বা খোঁজ রাখে? আমরা কি বাবুর মায়ের সেদিনের ব্যাথার ১% ও অনুভব করতে পারব? বাবু কেনই বা জীবন বাজি রেখে আবারো মুক্তিযুদ্ধে ফিরে গিয়েছিল? কিসের আশায়? দেশ তাকে কিছু দিবে, তার বিনিময় নেওয়ার জন্য কি?    


 মতিয়ার রহমান বাবু আমারই বন্ধু। আমরা ১৯৬৫ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত করমদি হাইস্কুলে এক সাথে পাঁচটি বছর কাটিয়েছি। স্বাধীনতার পর আমাদের দুজনের আঁকাবাঁকা পথ। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বাবু চাকুরির জন্য চেষ্টা, বিএ পাশ করেছিল কিনা মনে নেই। আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়ি ভাঙ্গার পথে রওয়ানা। সম্ভবত ৭২ সালের এক ঈদের আগের রাত্রি। করমদি হাইস্কুলের হেড স্যার আমাকে স্যারের বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে বাবু, শহিদুল, বাচ্চু, লুতফরের সাথে অনেক রাত পর্যন্ত চুটিয়ে আড্ডা। ভোর বেলায় সামান্য কিছু নাশতা করে দৌড়িয়ে বাড়ি ফিরে আসা এবং করমদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে জামাতে অংশগ্রহণ। এসবই এখন সৃতি। বাবু জনতা ব্যাংকে চাকরি করত, কুষ্টিয়া শাখায়। খুবই হ্যান্ডসাম সাদা ফুটফুটে চেহারা, আর সেজন্যই হয়তো চুটিয়ে প্রেম করে শেষাবধি বিয়ের আসনে বসা। হঠাৎ করেই সংবাদ এলো সে এজগত থেকে বিদায় নিয়েছে। একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাকে জাতি হারাল, কে তাকে মনে রাখবে?    


একটু মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেখানে কি অবস্থা। ধান কাঁটা শেষ। ন্যাড়া মাথার মুরব্বির ন্যায় চোখ দুটো ছোট করে সে যেন তাকিয়ে দেখছে কৃষক ভাই আবার কখন ফিরে আসবে, গরু লাঙ্গল নিয়ে সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু এলো কৃষকের পরিবর্তে খাকি পোশাক মাথায় হেলমেট পরিহিত কিছু অচেনা অজানা লোক। তাদের ভাষাও বুঝিনা। লাঙ্গলের পরিবর্তে নিয়ে এল কোদাল, ডালি ইত্যাদি। ইচ্ছা মত এদিক ওদিক খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হল, যেন কোন এক অমূল্য সম্পদের খোঁজে। জমির মালিকানা যেন হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে গেল। সমস্ত মাঠই ঐ খাকি পোশাক পরিহিত লোকদের অধিকারে, আর সেজন্যই যত্র তত্র গর্ত করতেও কোন অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন তারা অনুভব করে নাই। আর এই ব্যাক্তি গুলো হচ্ছে ইন্ডিয়ান আর্মি এবং বি এস এফ। আমি তাদের কার্যকলাপের সমালোচনা করছি না, শুধু বাস্তবতাটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।    


রামদেবপুর থেকে শুরু করে গরিবপুর হয়ে সহড়াতলা পর্যন্ত অসংখ্য পরিখা খনন করা হয়েছিল। এই জায়গাটি ছিল সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বামন্দি পাক আর্মি ক্যাম্পের সাথে মৌলিক পার্থক্য হল, বামন্দি ক্যাম্পের চারি পাশের ব্যাংকারটি তৈরি করা হয়েছিল নিজদেরকে রক্ষা করার জন্য, আর রামদেবপুর মাঠের পরিখা গুলো অপরকে আঘাত করার জন্য। তাই পরিখা গুলো পরিধি বা গভিরতার দিক থেকে তুলনামুলক ভাবে ছোট। শুধুমাত্র দুজন ব্যাক্তির বসার স্থান সঙ্কুলান করার জন্য। সেনা বাহিনিকে বিস্তৃত জায়গায় পজিসন দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি সিমিত আকারের মধ্যে রাখার একটা কৌশল। হেভি কোন অস্ত্র এখানে রাখা হয়না। সামনের বাহিনীগুলো সাধারণত ছোট ছোট অস্ত্র, খুব বেশী হলে এল এম জি বহন করবে। আর পিছন থেকে প্রয়োজনে মেশিন গান সেট করা হয় যেখান থেকে মর্টার নিক্ষেপ করা যেতে পারে। সামনের বাহিনীর কাজ হল শত্রু যেন খুব বেশী সামনে অগ্রসর হতে না পারে এবং ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়। কিন্তু একটি মর্টার নিক্ষেপ করলে প্রুচুর ক্ষতি হবে, আর সেটাকে avoid করাই হল মানবতা। সাধারনভাবে মনে করা হয় মিলিটারির প্রধান কাজ হল মানুষ খুন করা, কিন্তু আসলে তা নয়। মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়াই তাদের দায়িত্ব।  

 

এখন প্রশ্ন হল এই অসংখ্য পরিখা কারা খনন করেছিল? ইন্ডিয়ান আর্মি, না ভারত থেকে নিয়ে আসা সাধারন লোকজন, অথবা রামদেবপুর মথুরাপুরের মাঠে খাটা কৃষকগন? এখানে একরামুলের বক্তব্যটি তুলে ধরছি। [আমরা মাঝে মাঝে শরনার্থী হিসাবে কাদা পানি ভেঙ্গে তাজপুর হয়ে করিমপুর ২নং ক্যাম্পে যেতাম বাপের সাথে রিলিফ আনার জন্য । একদিন মথুরাপুর বিএসএফ ক্যাম্পের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, সাথে হাড়াভাঙ্গার লোকমান মেম্বর ছিল। বিএসএফ হাবিলদার বললো ব্যাংকারের উপর মাটি দিয়ে যেতে হবে। আমি ডালি কোদাল নিয়ে লেগে পড়লাম। লোকমান বললো আমার অভ্যাস নাই, আমি পারবো না।  হাবিলদার তখন বললো " শালুদের মাছ মরেছে, মাছের কাটা মরে নাই।" সেই গালিটার অর্থ তখন না বুঝলেও এখন বুঝি।] (একরামুল হক )  


এখানে আরেকজনের পাঠানো তথ্য তুলে ধরছি। 

[রামদেবপুর, গরীবপুর হয়ে সহড়াতলা পর্যন্ত অসংখ্য পরিখা খনন করা হয়েছিল যা এক প্রসংগে একরামুল উল্লেখ করেছিলেন । হ্যাঁ, আমি নিজেও ঐ পরিখা গুলো স্বচক্ষে দেখেছি। করমদির মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল ভাই এবং দেবিপুরের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাকী ভাইও এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। মোজাম্মেল ভাইকে ইন্ডিয়ান আর্মির একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন রাত্রিকালীন সময়ে গ্রামবাসী যেন আলো না জ্বালায় এবং উনাদের বাড়ির সামনে খালের উপর একটা বাঁশের সাঁকো তৈরি করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।] (আব্দুর রহিম)  


একটা প্রবাদ বাক্যের কথা মনে পড়ে গেল। ষাঁড়ে ষাঁড়ে করে লড়াই, উলুখড়ের প্রান যায়। এলাকার সাধারন জনগণ একসময় পাক আর্মির ব্যাংকার খননে বাধ্য হয়, আবার সেই ব্যাক্তিই বি এস এফের পরিখা খননে ব্যাস্ত থাকে। জনগন যেন একটি ফুটবল। যে যত জোরে লাথি মারবে, বলটি তত দূরে যেয়ে পৌঁছাবে। বলটির কোন আত্ম গ্যান নাই, সব মর্যাদাবোধ হল যে ফুটবলটিকে কিক করছে তার, সে যে দলেই থাকুক না কেন। যেহেতু আমরা মানুষ, সামান্য কিছু অনুভুতি আছে, তাই কেউ একরামুলের মত শত আগ্রহে, আবার কেউ লোকমান মেম্বরের মত চরম অনিহায় কাজটি করে আসে।  


এত প্রস্তুতি দেখে আমরা কি অনুমান করতে পারি? নিশ্চয়ই মিছে মিছে নয়, কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রস্তুতি। অল্প কিছুদিন পরেই আমরা সেই উদ্দেশ্যটিকে সচক্ষে দেখলাম।  


 

আজকে এখানেই শেষ করি

 ২২শে আগস্ট ২০২০

Meherpurtalentsস্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৩৫    সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি / রামদেবপুর মাঠে পরিখা খনন


No comments

Powered by Blogger.