স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৩
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ৩
জীবন বাঁচানোর কৌশল হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন
১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল, বলুনতো বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটি কিজন্য বিখ্যাত? সকলেই হয়তো উত্তরটা দিতে পারবেন। মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন হয় এইদিনেই। কিন্ত বলুনতো একই জেলায় ঠিক তারপরদিন অর্থাৎ ১৮ই এপ্রিলে কি ঘটেছিল? মজার বিষয় হল তারপরেও ১৮ দিয়ে সমাপ্তি হয়েছিল দিনটির এবং অত্যা্ন্ত মর্মান্তিকভাবে। ১৮-১৮?
চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুর রোড, মেহেরপুর শহরের নিকটে আমঝুপি গ্রাম। গ্রামটির বুক চিরে চলে গেছে এই রোডটি। বহু পুরাতন গ্রাম, ইংরেজরা এই গ্রামেই নদীর পাড়ে বানিয়েছল নীল কুঠি, সেই ইংরেজও নাই, নীলও নাই। সেইসাথে মানুষের উপর অত্যাচারও নাই। বর্তমানে গেস্টহাউস হিসাবে ব্যবহ্রত হচ্ছে এই বাড়িটি। আমিও জাপানি অতিথি নিয়ে এই গেস্টহাউসে রাত কাটিয়েছি এখন থেকে ৩ দশক আগে। আবার ছাত্র আন্দোলনের বৈঠকও করেছি একই বিল্ডিঙয়ের বারান্দাই, ভিতরে ঢোকার অনুমতি ছিলনা বলে। এখানে যেমন আছে বিনোদন করার মত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তেমনি আছে ব্রিটিশ জমিদারদের হুকুম অমান্য করে অন্য ফসল রোপন করার উপহার হিসাবে অন্ধ গুহার মধ্যে সারাজীবন কাটানোর নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র। শুনেছি দ্বাদশ শতাব্দীতে আরব থেকে ভারতবর্ষে আসা ইসলাম ধর্মপ্রচারকারিরা আমঝুপিতে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন।
প্রতিদিনের মত ১৮ই এপ্রিল কৃষকেরা ঘুম থেকে উঠে নিজ নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক সে সময়ই গর্জিয়ে উঠল কয়েকটি গাড়ীর বিকট শব্দ। সেইসাথে বুলেটের আওয়াজ, আকাশ বাতাস ভরে গেল মানুসের চিৎকারে। সম্ভবতঃ যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ৩ টি ট্রাকে ২৫-৩০ জন মিলিটারি এবং রাজাকার এসেছিল। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের মতামত অনুসারে পাকিস্তান মিলিটারির গাড়িতে ১০-১২ জন বাঙালি ছিল যাদেরকে আমরা রাজাকার বলে আখ্যায়িত করি। আবার এও বলা হচ্ছে তাদের মধ্যে দুজন ব্যাক্তি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং তারা মানুষের অনেক উপকার করেছে। গাড়ীগুলোর একটি আমঝুপি হাটে, একটি বাজারে, অপরটি চান্দবিলের দিকে যাওয়ার পথে ব্রিজের নিকট অবস্থান করছিল। এগুলো সবই আনুমানিক তথ্য।
১৮ই এপ্রিলের পরের যে ১৮, সেটাকি এখনও বুঝতে বাকি আছে? সেদিন আমঝুপিতে ১৮জনকে হত্যা করা হয় তাদেরই বাড়িতে, বাবা মা আত্মীয় স্বজনদের চোখের সামনে। একবার অনুমান করে দেখুন তো, যদি এই একই ঘটনা আপনার সামনে ঘটতো, তহলে আপনার অবস্থা কেমন হত? অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়েছে চিরদিনের জন্য। কেউবা স্বামীকে, কেউবা বাবাকে, কেউবা ছেলেকে। সংসারটি ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে ঘেছে এক মুহূর্তে। আজ তাদের সংবাদ কেইবা রাখে? ( তথ্য সংগ্রহে সেলিম রেজা )
বাংলাদেশে আমরা ইতিহাস পড়ি স্কুল কলেজে। অধিকাংশই হল কোন রাজা কোন রাজাকে খুন করে সিংহাসন দখল করলো ইত্যাদি। কিন্তু আমার ঘরের পাশে কি হয়েছে, সমাজ কি ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, সেই ইতিহাসের খোঁজও করিনা বা কোন গবেষক সেটাকে গবেষণার বিষয়বস্তু হিসাবে তুলেও ধরেনা। ক্ষমতা পরিবর্তনের সাথে সাথে ইতিহাস পরিবর্তন হয়ে যায়। দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবিগুলোও ক্ষণিকেই স্থান পরিবর্তন করে নেয়। কেউ দেওয়ালে, কেউ ডাস্টবিনে, আবার কেউ চলে যায় আলমারির পিছনে, যদি আবারো কখনো ব্যাবহার করা লাগে সেই আশাই। ইতিহাস, সেতো ইতিহাসই। তাকে তো আমি ইচ্ছামোতাবেক পরিবর্তন করতে পারিনা।
ফিরে আসি ১৮ই এপ্রিলে। কেন পাক বাহিনিরা ১৮টি প্রান কেড়ে নিল এইদিনে? এই সংখ্যাটি কি কোন অর্থ বহন করে? অথবা কাকতালীয়ভাবে? ১৮=১৮ সমান ভাবে দেখে উপভোগ করার জন্য? না, নিশ্চয়ই এর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে। আমরা তিনটা ঘটনাকে তুলে ধরতে পারি। একটি হোল ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী কেবিনেট তৈরি, দ্বিতীয় টি হোল মেহেরপুরের এস ডি ও তৌফিক এলাহি সাহেবের নিমকহারামি, কেননা তখনও তিনি পাক সরকারের একজন কর্মকর্তা, অথচ মুখে গুণগান করছেন শেখ মুজিবের। তৃতীয়টি হোল চুয়াডাঙ্গা মহকুমার তৎকালীন এস ডি ও কে হত্যাকরন। শুনেছি ভদ্রলোক ছিলেন পাঞ্জাবি, অত্যান্ত হ্যান্ডছাম। তাদেরকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই সমস্ত গ্লানিকে দূর করার জন্য প্রতিশোধ হিসাবে এই হত্যাযজ্ঞ কি নয়?
আসলে এই ব্যাখ্যাগুলোকে আমরা যেভাবেই নিইনা কেন, একনায়কদের অন্তরে সর্বদা একটা ভীতি কাজ করে, সেটি হলো কখন তার গদিটা চলে যাবে, আর গদি চলে যাওয়ার অর্থই হল নির্ঘাত তার মৃত্যু। আমরা মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকাতে এমন উদাহরন অনেক দেখেছি। পাক মিলিটারি সরকারের উদ্দেশ্য ছিল প্রথমেই জনগণের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে দেওয়া, আর সেজন্যই তারা দেশের বিভিন্ন জায়গাই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তার ফল হয়েছে উল্টো।
আরেকটি ঘটনা করমদি গ্রামে, যেখানে আমার জন্ম এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত একনাগাড়ে কাটিয়েছি। দিনটির তারিখ মনে নেই, তবে ১৮ই এপ্রিলের কাছাকাছি কোন এক সময় হবে। গ্রামটি কুষ্টিয়া -মেহেরপুর রোডের বামন্দি বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৫ কিলো পশ্চিমে। হেটে এক ঘণ্টা লাগতো। গরুর গাড়ি অথবা পায়ে হেটে চলা। আমরা প্রায়ই পা হেটে যেতাম। গ্রামটি পূর্ব পশ্চিম লম্বা, প্রায় চার কিলো। গ্রামের সীমানায় ঢোকার পর প্রথমেই চোখে পড়বে মাঠপাড়া, দেড় কিলো দূরে কুমোরপাড়ুা সেখানেই রাস্তাটি ৪৫ ডিগ্রি মোড় নিয়েছে। আর কুমোরপাড়া থেকে উত্তর পশ্চিমে বহল্ পাড়া। এই পাড়াতেই আমার জন্ম, এখনও সেখানেই আমাদের তিন ভাই বাস করে, আমাদের জন্য রক্ষিত বাড়ীতে এখন আর কেউ থাকেনা। আমাদের বাবা মাও এই বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
বর্তমানে করমদি পূর্ব পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (জাপানী স্কুল নামেই পরিচিত) ঠিক পিছনে আমাদের বাঁশ বাগান। আমরা গরমের দিনে এখানে সময় কাটাতাম। একদিন আমরা দুপুরের একটু আগে বাঁশ বাগানের ভিতরে হৈ হুল্লোড় করছি, এমন সময় মোটর গাড়ির শব্দ, চেয়ে দেখি কুমোরপাড়ার মধ্য দিয়ে একটা ট্রাক চলে গেল, আর সেইসাথে কিছু মানুষের কান্নার হাহাকার।পরে জানলাম খবির চাচাকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেল। খবির চাচাদের বাড়িটি ঠিক কুমোরপাড়ার মোড়ে। আমরা তাকে চাচা বলে ডাকতাম, যদিও তেমন কোন আত্মীয় হতনা। স্কুলজীবনে আমার থেকে এক বছরের বড়। তবে বাস্তবে আমার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের বড় হবে মনে হয়। আমরা তখন বাশবাগানের কাছেই নিচু জায়গাতে আত্মগোপন করার মিথ্যা চেষ্টা করছিলাম। ট্রাকটি কুমোরপাড়া পার হয়ে করমদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে মোড় নিল। গোসাইডুবি পাড়া এবং বাগানপাড়ার মাঝখানে একটি ছোট ব্রিজ। ব্রিজের উভয় দিকের মাটি পানিতে ভেসে যেয়ে নীচু হয়ে গেছে। ট্রাকটি যখন ব্রিজের উপর উঠে আবার নীচে নেমেছে, তখন বিকট এক শব্দ, আমরা মনে করলাম খবির চাচাকে হয়তো গুলি করে মারলো। আত্মীয় স্বজনদের কান্নার সুরটা আরও বেড়ে গেল।
ঘণ্টা খানেক পর হঠাৎ খবির চাচার আবির্ভাব, কিন্তু রাস্তা দিয়ে নয়, মাঠের ভিতর দিয়ে, ছোট ছোট আঁখ বাগান অতিক্রম করে। আসলে খবির চাচার দুটি পায়ের একটি ছিল খাট। হাটতে তেমন অসুবিধা হতনা, দৌড়াতে কষ্ট হতো। কিন্তু সেদিন খবির চাচা অনেক খানি রাস্তা দৌড়ীয়ে এসেছিল। পরে শুনেছিলাম ট্রাকে কয়েকজন বাঙালি ছিল, তাদের একজন খবির চাচাকে পালাতে সাহায্য করেছিল। আর এই ঘটনাটিই আমার জীবনে বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়াল।
যদি মরতেই হয়, তবে কাপুরুষের মত নয়, যুদ্ধ করেই বীরপুরুষের মত মরবো।
coppy from FB
জীবন বাঁচানোর কৌশল হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন
১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল, বলুনতো বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটি কিজন্য বিখ্যাত? সকলেই হয়তো উত্তরটা দিতে পারবেন। মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন হয় এইদিনেই। কিন্ত বলুনতো একই জেলায় ঠিক তারপরদিন অর্থাৎ ১৮ই এপ্রিলে কি ঘটেছিল? মজার বিষয় হল তারপরেও ১৮ দিয়ে সমাপ্তি হয়েছিল দিনটির এবং অত্যা্ন্ত মর্মান্তিকভাবে। ১৮-১৮?
চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুর রোড, মেহেরপুর শহরের নিকটে আমঝুপি গ্রাম। গ্রামটির বুক চিরে চলে গেছে এই রোডটি। বহু পুরাতন গ্রাম, ইংরেজরা এই গ্রামেই নদীর পাড়ে বানিয়েছল নীল কুঠি, সেই ইংরেজও নাই, নীলও নাই। সেইসাথে মানুষের উপর অত্যাচারও নাই। বর্তমানে গেস্টহাউস হিসাবে ব্যবহ্রত হচ্ছে এই বাড়িটি। আমিও জাপানি অতিথি নিয়ে এই গেস্টহাউসে রাত কাটিয়েছি এখন থেকে ৩ দশক আগে। আবার ছাত্র আন্দোলনের বৈঠকও করেছি একই বিল্ডিঙয়ের বারান্দাই, ভিতরে ঢোকার অনুমতি ছিলনা বলে। এখানে যেমন আছে বিনোদন করার মত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তেমনি আছে ব্রিটিশ জমিদারদের হুকুম অমান্য করে অন্য ফসল রোপন করার উপহার হিসাবে অন্ধ গুহার মধ্যে সারাজীবন কাটানোর নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র। শুনেছি দ্বাদশ শতাব্দীতে আরব থেকে ভারতবর্ষে আসা ইসলাম ধর্মপ্রচারকারিরা আমঝুপিতে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন।
প্রতিদিনের মত ১৮ই এপ্রিল কৃষকেরা ঘুম থেকে উঠে নিজ নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক সে সময়ই গর্জিয়ে উঠল কয়েকটি গাড়ীর বিকট শব্দ। সেইসাথে বুলেটের আওয়াজ, আকাশ বাতাস ভরে গেল মানুসের চিৎকারে। সম্ভবতঃ যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ৩ টি ট্রাকে ২৫-৩০ জন মিলিটারি এবং রাজাকার এসেছিল। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের মতামত অনুসারে পাকিস্তান মিলিটারির গাড়িতে ১০-১২ জন বাঙালি ছিল যাদেরকে আমরা রাজাকার বলে আখ্যায়িত করি। আবার এও বলা হচ্ছে তাদের মধ্যে দুজন ব্যাক্তি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং তারা মানুষের অনেক উপকার করেছে। গাড়ীগুলোর একটি আমঝুপি হাটে, একটি বাজারে, অপরটি চান্দবিলের দিকে যাওয়ার পথে ব্রিজের নিকট অবস্থান করছিল। এগুলো সবই আনুমানিক তথ্য।
১৮ই এপ্রিলের পরের যে ১৮, সেটাকি এখনও বুঝতে বাকি আছে? সেদিন আমঝুপিতে ১৮জনকে হত্যা করা হয় তাদেরই বাড়িতে, বাবা মা আত্মীয় স্বজনদের চোখের সামনে। একবার অনুমান করে দেখুন তো, যদি এই একই ঘটনা আপনার সামনে ঘটতো, তহলে আপনার অবস্থা কেমন হত? অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়েছে চিরদিনের জন্য। কেউবা স্বামীকে, কেউবা বাবাকে, কেউবা ছেলেকে। সংসারটি ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে ঘেছে এক মুহূর্তে। আজ তাদের সংবাদ কেইবা রাখে? ( তথ্য সংগ্রহে সেলিম রেজা )
বাংলাদেশে আমরা ইতিহাস পড়ি স্কুল কলেজে। অধিকাংশই হল কোন রাজা কোন রাজাকে খুন করে সিংহাসন দখল করলো ইত্যাদি। কিন্তু আমার ঘরের পাশে কি হয়েছে, সমাজ কি ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, সেই ইতিহাসের খোঁজও করিনা বা কোন গবেষক সেটাকে গবেষণার বিষয়বস্তু হিসাবে তুলেও ধরেনা। ক্ষমতা পরিবর্তনের সাথে সাথে ইতিহাস পরিবর্তন হয়ে যায়। দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবিগুলোও ক্ষণিকেই স্থান পরিবর্তন করে নেয়। কেউ দেওয়ালে, কেউ ডাস্টবিনে, আবার কেউ চলে যায় আলমারির পিছনে, যদি আবারো কখনো ব্যাবহার করা লাগে সেই আশাই। ইতিহাস, সেতো ইতিহাসই। তাকে তো আমি ইচ্ছামোতাবেক পরিবর্তন করতে পারিনা।
ফিরে আসি ১৮ই এপ্রিলে। কেন পাক বাহিনিরা ১৮টি প্রান কেড়ে নিল এইদিনে? এই সংখ্যাটি কি কোন অর্থ বহন করে? অথবা কাকতালীয়ভাবে? ১৮=১৮ সমান ভাবে দেখে উপভোগ করার জন্য? না, নিশ্চয়ই এর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে। আমরা তিনটা ঘটনাকে তুলে ধরতে পারি। একটি হোল ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী কেবিনেট তৈরি, দ্বিতীয় টি হোল মেহেরপুরের এস ডি ও তৌফিক এলাহি সাহেবের নিমকহারামি, কেননা তখনও তিনি পাক সরকারের একজন কর্মকর্তা, অথচ মুখে গুণগান করছেন শেখ মুজিবের। তৃতীয়টি হোল চুয়াডাঙ্গা মহকুমার তৎকালীন এস ডি ও কে হত্যাকরন। শুনেছি ভদ্রলোক ছিলেন পাঞ্জাবি, অত্যান্ত হ্যান্ডছাম। তাদেরকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই সমস্ত গ্লানিকে দূর করার জন্য প্রতিশোধ হিসাবে এই হত্যাযজ্ঞ কি নয়?
আসলে এই ব্যাখ্যাগুলোকে আমরা যেভাবেই নিইনা কেন, একনায়কদের অন্তরে সর্বদা একটা ভীতি কাজ করে, সেটি হলো কখন তার গদিটা চলে যাবে, আর গদি চলে যাওয়ার অর্থই হল নির্ঘাত তার মৃত্যু। আমরা মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকাতে এমন উদাহরন অনেক দেখেছি। পাক মিলিটারি সরকারের উদ্দেশ্য ছিল প্রথমেই জনগণের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে দেওয়া, আর সেজন্যই তারা দেশের বিভিন্ন জায়গাই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তার ফল হয়েছে উল্টো।
আরেকটি ঘটনা করমদি গ্রামে, যেখানে আমার জন্ম এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত একনাগাড়ে কাটিয়েছি। দিনটির তারিখ মনে নেই, তবে ১৮ই এপ্রিলের কাছাকাছি কোন এক সময় হবে। গ্রামটি কুষ্টিয়া -মেহেরপুর রোডের বামন্দি বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৫ কিলো পশ্চিমে। হেটে এক ঘণ্টা লাগতো। গরুর গাড়ি অথবা পায়ে হেটে চলা। আমরা প্রায়ই পা হেটে যেতাম। গ্রামটি পূর্ব পশ্চিম লম্বা, প্রায় চার কিলো। গ্রামের সীমানায় ঢোকার পর প্রথমেই চোখে পড়বে মাঠপাড়া, দেড় কিলো দূরে কুমোরপাড়ুা সেখানেই রাস্তাটি ৪৫ ডিগ্রি মোড় নিয়েছে। আর কুমোরপাড়া থেকে উত্তর পশ্চিমে বহল্ পাড়া। এই পাড়াতেই আমার জন্ম, এখনও সেখানেই আমাদের তিন ভাই বাস করে, আমাদের জন্য রক্ষিত বাড়ীতে এখন আর কেউ থাকেনা। আমাদের বাবা মাও এই বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
বর্তমানে করমদি পূর্ব পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (জাপানী স্কুল নামেই পরিচিত) ঠিক পিছনে আমাদের বাঁশ বাগান। আমরা গরমের দিনে এখানে সময় কাটাতাম। একদিন আমরা দুপুরের একটু আগে বাঁশ বাগানের ভিতরে হৈ হুল্লোড় করছি, এমন সময় মোটর গাড়ির শব্দ, চেয়ে দেখি কুমোরপাড়ার মধ্য দিয়ে একটা ট্রাক চলে গেল, আর সেইসাথে কিছু মানুষের কান্নার হাহাকার।পরে জানলাম খবির চাচাকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেল। খবির চাচাদের বাড়িটি ঠিক কুমোরপাড়ার মোড়ে। আমরা তাকে চাচা বলে ডাকতাম, যদিও তেমন কোন আত্মীয় হতনা। স্কুলজীবনে আমার থেকে এক বছরের বড়। তবে বাস্তবে আমার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের বড় হবে মনে হয়। আমরা তখন বাশবাগানের কাছেই নিচু জায়গাতে আত্মগোপন করার মিথ্যা চেষ্টা করছিলাম। ট্রাকটি কুমোরপাড়া পার হয়ে করমদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে মোড় নিল। গোসাইডুবি পাড়া এবং বাগানপাড়ার মাঝখানে একটি ছোট ব্রিজ। ব্রিজের উভয় দিকের মাটি পানিতে ভেসে যেয়ে নীচু হয়ে গেছে। ট্রাকটি যখন ব্রিজের উপর উঠে আবার নীচে নেমেছে, তখন বিকট এক শব্দ, আমরা মনে করলাম খবির চাচাকে হয়তো গুলি করে মারলো। আত্মীয় স্বজনদের কান্নার সুরটা আরও বেড়ে গেল।
ঘণ্টা খানেক পর হঠাৎ খবির চাচার আবির্ভাব, কিন্তু রাস্তা দিয়ে নয়, মাঠের ভিতর দিয়ে, ছোট ছোট আঁখ বাগান অতিক্রম করে। আসলে খবির চাচার দুটি পায়ের একটি ছিল খাট। হাটতে তেমন অসুবিধা হতনা, দৌড়াতে কষ্ট হতো। কিন্তু সেদিন খবির চাচা অনেক খানি রাস্তা দৌড়ীয়ে এসেছিল। পরে শুনেছিলাম ট্রাকে কয়েকজন বাঙালি ছিল, তাদের একজন খবির চাচাকে পালাতে সাহায্য করেছিল। আর এই ঘটনাটিই আমার জীবনে বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়াল।
যদি মরতেই হয়, তবে কাপুরুষের মত নয়, যুদ্ধ করেই বীরপুরুষের মত মরবো।
No comments