স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২৬ রাজাকার জব্দ / Some memories of independence 26
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২৬রাজাকার জব্দ
আমরা যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রকে যুদ্ধাস্ত্র বলে থাকি। সেগুলো আবার ছোট বড় বিভিন্ন সাইজের, বিভিন্ন শক্তির। যেমন ইয়াকুবের বাবাকে মারার জন্য মাইন ব্যবহার করা হয়েছিল, আজিজুলকে মারার জন্য রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছিল, রামদেবপুরের মাঠে যুদ্ধ করার জন্য এল এম জি এবং পরবর্তীতে মটর শেল ব্যাবহার করা হয়েছিল। সবগুলই কিন্তু মানুষকে মারা বা ঘায়েল করার জন্য। আচ্ছা, এগুলোর ব্যবহার কি শুধুমাত্র এই কাজের জন্যই? অন্য কোন ব্যবহার কি নাই? আমরা জানি সবকিছুরই পজিটিভ এবং নেগাটিভ দিক আছে। তাহলে রাইফেল ব্যাবহার করার ক্ষেত্রে কি তেমনটি নাই? আমরা যেমন ঔষধ খাই অসুখ ভাল করার জন্য, তেমনি আবার ঔষধ খেয়েই এ জগৎ থেকে বিদায় নেওয়া হয়। অবশ্যই পজিটিভ দিক আছে। আমি এই রাইফেল দিয়েই একজন মুক্তিযোদ্ধাকে মানুষ মারা থেকে বিরত রাখতে পেরেছিলাম। দেখি, আমরা সেই রাইফেলকে কিভাবে ব্যবহার করতে পারি।
সম্ভবত অক্টোবর মাসের কোন এক দিন। আমরা সহড়াবাড়ী, সিমুলতলা এলাকায় ট্রেনিং করাচ্ছিলাম। কোথায় রাত কাটিয়েছিলাম, ঠিক মনে নাই। তবে আমাদের সাথে শিমুলতলার খালেক ছিল, এটা নিশ্চিত। এছাড়া একই গ্রামে একজন মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন, নাম ইছাহক বিশ্বাস। তাদের রাইচ মিল ছিল, আমাদের বাড়ি থেকেও মাঝে মাঝে গাড়ি ভর্তি ধান নিয়ে যেত ঐ মিলে চাল করার জন্য। ঐতিহ্যগত ভাবে মুসলিম লীগের সাপোর্টার হলেও তার দুই ছেলে আমাদের সাথে ট্রেনিং নিত। আমরা তার বাড়িতে এক রাতে খেয়েছিলাম।
আমাদেরকে একজন সংবাদ দিল গাংনীর পূর্ব দিকে বোয়ালিয়া যাওয়ার পথে একটা ব্রিজ আছে, এবং সেখানে রাজাকাররা পাহারা দিচ্ছে। তাদের নিকটে তেমন কোন ভারি অস্ত্র নাই। তাদেরকে আক্রমন করা যেতে পারে। আমরা এই প্রস্তাবে রাজি হলাম। কিন্তু বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য মুছাব এবং কাদেরকে পাঠানো হল রেকি করার জন্য। তাদের রিপোর্টেও একই ধরনের সংবাদ পাওয়া গেল। সিদ্ধান্ত হল আমরা ঐ রাজাকারদের আক্রমন করব। আমাদের টিম লিডার মোফাজ্জেলের নির্দেশ হল রাজাকারদেরকে আমরা গুলি করে মারব না। প্রথমে তাদেরকে সারেন্ডার করার জন্য বলব।
আমাদের সাথে মিনাপাড়ার মকবুল, আশরাফুলও ছিল। আমরা রাইপুরের দিক থেকে ব্রিজের কাছাকাছি এসে পৌছালাম। রাত্রি তখন ১১ টার মত হবে। গ্রামের রাস্তা, তদুপরি যুদ্ধের সময়, তাই জনগন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া রাত্রি বেলায় বাইরে বের হত না। আমরা দেখলাম রাস্তার উত্তর এবং দক্ষিন দিকে ৫ জন করে মোট ১০ জন রাজাকার রাস্তা পাহারা দিচ্ছে। তাদের ভিতর লক্ষ্য করা গেল হঠাৎ কোন বিপদ আসতে পারে এমন কোন টেনশন নাই। একত্রিত হয়ে আরামের সাথে গল্প করছে। আমরা দেখলাম সকলের কাছে রাইফেল নাই। কয়েকজনের নিকট বাঁশের লাঠি আছে। আমরা সাথে করে রাইফেল ছাড়াও হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা চিৎকার করে বললাম হ্যান্ডস আপ, রাজাকাররা থতমত খেয়ে গেল। আমরা তাদেরকে দেখালাম আমাদের সাথে কি আছে। অতএব আমাদের নির্দেশ অনুসারে না চললে তাদের জীবনে বাঁচার কোন উপায় নাই। আর আমরা চারিদিকে তোমাদেরকে ঘিরে ফেলেছি। ওরা আমাদের নির্দেশ মোতাবেক রাইফেল এবং লাঠিগুলোকে মাটিতে ফেলে দিয়ে কয়েক গজ দূরে এসে দাঁড়াল। আমরা ওদের গোটা শরীর চেক করলাম, বিশেষ করে কোমর। অপরদিকে রাইফেলগুলোকে আমাদের আওতায় নিয়ে এলাম। দশজনের জন্য ৬/৭ টা রাইফেল ছিল। লুকানো কোন ধারালো অস্ত্র পাওয়া গেলনা। ওরা আমাদের কাছে কাকুতি মিনতি করতে লাগল আমরা যেন তাদেরকে মেরে না ফেলি। আমরাও আশ্বাস দিলাম তাদের শরীরে কোন আঘাত করব না।
ঘটনা স্থলে বেশী সময় অপেক্ষা করা সামরিক কৌশলের বহির্ভূত। তাই ঝটপট করে ওদের কোমরে রশি বেঁধে হাঁটতে শুরু করলাম। যদিও কোন রাস্তায় এসেছিলাম স্পষ্ট মনে নাই, তবু স্মৃতি থেকে যতটুকু মনে হয় আমরা মালশাদহ হয়ে ধর্মচাকি, ভোমরদহ, ভরাট হয়ে করমদি বাঘপাড়া হয়ে ব্রজনাথপুরে পৌঁছালাম। ইতিমধ্যে সকাল হয়ে গেছে।
সমস্যা হল এদেরকে নিয়ে কি করব? ওদেরেকে রাখতে হলে খাবার দিতে হবে, থাকার জায়গা দিতে হবে। আমাদের খাওয়া দাওয়া সব কিছুই নিজ খরচে, আবার থাকিও অন্যের বাসায়। আবার রাত জেগে পাহারা দিতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় একটা বিহিত করতে হবে। ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে হবে। ওদের বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করলাম। অধিকাংশেরই বাড়ি গোপালনগর, রাইপুর, মালশাদহ অর্থাৎ ঘটনাস্থলের খুব কাছাকাছি। আমরা আরও জিজ্ঞাসা করলাম তাদের ছেড়ে দেওয়া হলে তারা কি পুনরায় রাজাকারে যোগদান করবে কিনা। ওরা নিজের ইচ্ছায় রাজাকার হয় নাই। গ্রামের শান্তি কমিটির চাপে বা পিড়াপীড়িতে রাজাকারে নাম লিখিয়েছে, আবার এর বিনিময়ে কিছু বেতনও পাবে। আর কখনই রাজাকারে যাবেনা। বরং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করবে বলে তাদের মনোভাব প্রকাশ করল। কিন্তু এদেরকে তো বিশ্বাস করাও কঠিন। একবার ছাড়া পেলে আমাদেরই বিপদ ডেকে আনবে কি না তার কোন নিশ্চয়তা নাই। তারা আরও বলল, অনেক আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না। আজ বরং সেই সুযোগ পেয়ে খুব ভাল লাগেছে, এখন থেকে অন্তত সামান্য হলেও দেশের জন্য কিছু কাজ করতে পারব। এখানে বলে রাখি, আমাদের নিকটে রাইফেল ছিল বলেই রাজাকাররা আমদের দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়ে নাই। তারা জানত তাদের একটা গুলির বিনিময়ে অনেকগুলো গুলি তাদের দিকে তাক করে বসে আছে, যেকোন মুহূর্তে তাদের জীবন চলে যেতে পারে। আমরা ইচ্ছা করলে রাজাকারদেরকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারতাম, আমরা সেটা করলাম না।
আমাদের জনৈক মুজিব বাহিনীর সদস্যের প্রস্তাব হল ওদেরকে মেরে ফেলা। সমরক্ষেত্রে যুদ্ধ অবস্থায় যদি কেউ শত্রুপক্ষের বা এমনকি সাধারন জনগণকেও গুলি করে হত্যা করে, তার জন্য সে দায়ী হবে না। কিন্তু কোন কয়েদি বা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আটক করা কোন ব্যাক্তিকে যদি হত্যা করা হয়, তার জন্য হত্যাকারীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। অতএব আমরা মুজিব বাহিনীর সদস্যের প্রস্তাব নাকচ করে অন্য কোন পথ আছে কিনা ভেবে দেখার জন্য বললাম। শেষে সিদ্ধান্ত হল রাজাকারদেরকে বেতাইয়ের ট্রানজিট ক্যাম্পে পৌছিয়ে দিয়ে ঝামেলা মুক্ত হওয়া। কিন্তু রাজাকারদের রাইফেল গুলো কি করা হবে? আমাদের প্রত্যেকের একটা করে রাইফেল আছে, অতএব অতিরিক্ত রাইফেলেরে প্রয়োজন নাই। রাইফেল গুলো থেকে অনেক আগেই ম্যাগাজিন গুলো বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, গুলি ও ভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। আমাদের সাথে যদি অতিরিক্ত রাইফেল থাকে, সেগুলো হয়তো কোন অশুভ কাজে ব্যাবহার হতে পারে। পরদিন রাজাকারদের কাঁধে উঠিয়ে দেওয়া হল ম্যাগাজিন বিহীন রাইফেল গুলো। তারপর ইন্ডিয়ার বেতাইয়ের পথে যাত্রা। কারা সাথে গিয়েছিল আমার সঠিক মনে নাই, তবে টীম লিডারের বক্তব্য অনুসারে কাদের, মকবুল এবং মুছাব ওদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা একদিকে বিচারকের দায়িত্ব থেকে দূরে থাকলাম, অপরদিকে ১০ টি প্রান রক্ষা পেল। মানুষকে মেরে ফেলা খুব সহজ, কিন্তু বাঁচিয়ে রাখা তার চেয়ে অনেক গুন কঠিন।
Some memories of independence 26 |
আজকে এখানেই শেষ
©
No comments