স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২৪ এবারে সম্মুখ যুদ্ধ, রামদেবপুর মাঠে / Some memories of independence 24 This time the battle ahead, at Ramdevpur ground.
স্বাধীনতার কিছু স্মৃতি ২৪এবারে সম্মুখ যুদ্ধ, রামদেবপুর মাঠে
আমরা অর্থাৎ মুজিব বাহিনীর সদস্যগন এ পর্যন্ত সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিই নাই। আর সম্মুখ যুদ্ধ আমাদের কর্ম পরিকল্পনার অংশও নয়। কিন্তু হঠাৎ করেই এমন কিছু অবস্থা তৈরি হয় যখন বাধ্য হতে হয় এই আদর্শ ভংগনের। রামদেবপুর মাঠে যুদ্ধে অংশগ্রহনও তেমনই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তারিখটা আমার স্পষ্ট মনে নাই। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাম্মেলের মত অনুসারে দিনটি ছিল ২০ শে সেপ্টেম্বর, কিন্তু রফিকুর রশিদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বইয়ে বলা হচ্ছে ৪ ঠা নভেম্বর। দুটো তারিখেরই যৌক্তিকতা আছে। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝিতে রোজা শুরু, অতএব এই সময়ের আগে বা পরে বড় একটা অভিযান চালিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে উল্লেখযোগ্য রেজাল্ট দেখান। এর ভিতর কৃতিত্ব আছে। আছে প্রমোশন। ২০শে সেপ্টেম্বর তারিখটাই হয়তো সঠিক। কারন ২২ শে সেপ্টেম্বর তেতুলবাড়িয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জনাব নুরুল হুদা বিশ্বাসের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ২০ তারিখের যুদ্ধের সাথে বাড়িতে আগুন লাগানোর সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায়না। অর্থাৎ পাক বাহিনিরা ২০ তারিখের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার গ্লানি দূর করার জন্যই চেয়ারম্যানের বাড়িতে আগুন।
যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে রফিকুর রশিদ লিখিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মেহেরপুর জেলা ২৪১ পৃষ্ঠাতে লিখেছে। আমি আর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চাইনা। বরং আমাদের সাথে এই যুদ্ধের সম্পর্ক নিয়েই লিখতে চাই। মোজাম্মেলের মন্তব্য অনুসারে সে তার দলের ১০ জন সদস্য নিয়ে তেতুলতলা/ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। এরা হচ্ছে ① মোজাম্মেল হক ② আব্দুল বাকি ③ ইয়ামিন আলী ④ মামুনুর রশিদ ⑤ শহিদুল ইসলাম ⑥ সাহাবুসদ্দিন ⑦ আবু বকর ⑧ আব্দুল কুদ্দুস ⑨ হারেজ উদ্দিন ⓾ সাইদুর রহমান
মোজাম্মেল সকাল বেলায় তাদে্রকে নিয়ে রামদেবপুর হয়ে করমদিতে আসছিল। পথিমধ্যে জানতে পারে পাক বাহিনী পলাশিপাড়ার পাগলা ব্রিজের নিকটে ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। তাই মোজাম্মেলের নির্দেশে রামদেবপুর ফুটবল মাঠের আশে পাশে তারা পজিশন নেয়। এদিকে আব্দুল হান্নান এবং আজগর আলির নেতৃত্তে আরো কিছু মুক্তিযোদ্ধা রামদেবপুরের বিভিন্ন স্থানে পজিশন নেয়। রফিকুর রশিদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বইতে লেখা আছে মুক্তিযোদ্ধাদের পজিশন নির্ধারণ করেন নুরুল হুদা বিশ্বাস। তথ্যের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারন সেসময় আমাদের নিকট ছিল না কোন যোগাযোগ ডিভাইস। এক দলের সাথে আরেক দলের সাংগঠনিক ভাবে কোন সমন্নয়ও ছিল না। ছিল না কোন চেইন অব কমান্ড। প্রতিটা দলই নিজ নিজ সুবিধায় নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুসারে বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহন করে। আমরা পজিশন নিলাম রামদেবপুর এবং গরিবপুর এর মাঝখানের এলাকায়। কারন আমাদের কিছু সদস্য সেদিন ব্রজনাথপুর থেকে এসেছিল। আমার আবছা আবছা মনে হচ্ছে সেদিন রাত্রে আমরা কয়েকজন মুজিব বাহিনীর সদস্য রামদেবপুরের মোবারক বিশ্বাস অর্থাৎ তেতুলবাড়িয়া হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আবুল হোসেনের পিতার বাড়িতে ছিলাম। কিন্তু আবুল ভাইকে তথ্যের সঠিকতা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোন সঠিক উত্তর দিতে পারেন নাই। আমরা যেখা্নেই রাত্রি কাটাইনা কেন, যুদ্ধে অনশগ্রহন করেছি এটাই যথেষ্ট।
মুজিব বাহিনীর পক্ষ থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহনকারিরা নিম্নরূপ
①মোফাজ্জেল হক ② মোখলেছুর রহমান ③ আব্দুল কাদের ④ মকবুল হোসেন ⑤ আশরাফুল ইসলাম ⑥ মুছাব আলী ⑦ আশরাফুল হক ⑧ সহযোগী গোলাম মোস্তফা
যুদ্ধাস্ত্র বলতে মোজাম্মেলের নিকট ছিল একটি এল এম জি, আর মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মোফাজ্জেলের নিকটে ছিল একটি এস এল আর। অটোমেটিক মেশিন বলতে এই দুটোই সবে ধন নীলমনী। এগুলো দিয়ে একাধারে গুলি অর্থাৎ ব্রাশ ফায়ার করা যায়, কিন্তু নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও বেশী, এছাড়া বিশেষ করে এল এম জি অনেক ভারি হওয়ার কারনে ক্যারি করা মুশকিল। বাকিগুলো রাইফেল, একটা একটা করে গুলি করা লাগে।
পাক বাহিনী প্রথমে ভেবেছিল আমাদেরকে সাঁড়াশি অভিযান করে কন্ট্রোল করবে। এবং সেজন্যই তারা পাগলা ব্রিজের নিকটে এসে কিছু সেনা সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে পলাশিপাড়া গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ল, কিন্তু সামনের দিকে আর অগ্রসর হল না। তারা বজলু বা ফড়ুদের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পজিসন নিল। আর একদল ডান দিকে মোড় নিয়ে মোজাম্মেলদের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে। বাঁধা সাধলো একটা খাল। খালটি গরিবপুর হয়ে করমদি পশ্চিম পাড়া হয়ে পলাশিপাড়ার কিনার ঘেঁসে চলে গেছে হিন্দার দিকে। এই খালের নাম কুমড়াডোবা। অপর দিকে তেতুলবাড়িয়া হয়ে পলাশিপাড়া হয়ে আরেকটি খাল চলে গেছে হিন্দার দিকে। এই খালের নাম ইছামতী। তেতুলবাড়িয়া অংশে এর নাম কালিদহ। পাগলার ব্রিজের নিকটে দুটো খাল একসাথে হয়ে হিন্দার দিকে চলে গেছে। এটাকে কেন পাগলার ব্রিজ বলা হয়, এ নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। কুমড়াডোবা খালের পাড়ে মোজাম্মেলদের বাড়ি। ঠিক তাদের বাড়ির সামনেই কয়েকটা পুকুর ছিল। রামদেবপুরের দিকে যাওয়ার জন্য দুই পুকুরের মাঝখানে একটা বাঁধ ছিল। কয়েকজন পাক বাহিনী এখানে এসে থমকে দাঁড়াই, খাল পার হবে কিনা এই ভেবে। একজন সেনা সদস্য একটা গাছে উঠে দেখল আশে পাশের অবস্থা পরিক্ষা করে দেখল, তার ইশারাতেই ২/৩জন সেনা ঐ বাঁধ পাড়ি দিল, কিন্তু সামনে এগুলনা। যুদ্ধের কৌশল হল সামনের দিকের চেয়ে পিছনের দিকটা শত্রুমুক্ত রাখা।
আসলে আমরা ছিলাম সামরিক কৌশলের দিক থেকে খুবই ভাল পজিশনে। কারন আমাদের পিছনে পর্যাপ্ত সমতল ভুমি। নদীনালা নাই, বাধা দেওয়ার কোন বস্তু নাই। কিন্তু যেহেতু অন্য কোন রাস্তা নাই তাই পাক বাহিনীকে আমরা পাগলার ব্রিজে আটকাতে পারি, আবার যদি তারা মোজাম্মেলদের বাড়ির সামনের পায়ে হাঁটার বাঁধ পাড়ি দিয়ে রামদেবপুরের দিকে ঢুকে যায়, সেখানেও তারা আটকা পড়ার সম্ভাবনা এবং এটা হবে মৃত্যু ফাঁদ suicidal act। তাই পাক বাহিনী সামনের দিকে অগ্রসর না হয়ে পাগলার ব্রিজ পাহারা দেওয়ার জন্য কিছু সেনা (defense), পলাশিপাড়া থেকে আক্রমন করার জন্য কিছু সেনা (offense), এবং মোজাম্মেলদের পুকুর পাড় থেকে গোটা মাঠ অর্থাৎ রণাঙ্গন দেখে মিত্রপক্ষকে নির্দেশ দেওয়ার (observation) জন্য মোতায়েন করেছিল কয়েকজনকে।
পলাশিপাড়াই অবস্থানরত পাক সেনাদের উদ্দেশ্য করে মোজাম্মেল এল এম জি দিয়ে আক্রমন শুরু করলো, সেই সাথে শত্রুপক্ষও। মামুন তার সহযোগী হিসাবে গুলি সংরক্ষন এবং সরবরাহের দায়িত্তে। কিন্তু বাধ সাধল তার অস্ত্র, এল এম জি গরম হয়ে যেয়ে আর ফায়ার হয় না। অকেজো অস্ত্র নিয়ে রণাঙ্গনে অবস্থানের চেয়ে পিছু হটাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ। মোজাম্মেল স্থান পরিবর্তন করে এল এম জির চ্যাম্বার পরিস্কার করে পুনরায় গুলি ভর্তি করতে যেয়ে দেখে গুলি নাই, মামুন ওগুলো নিয়ে আত্মরক্ষার জন্য কোথাও নিরাপদ জায়গাই চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত পিছন হটা ছাড়া কোন গতি নাই।
এদিকে আমাদের দলের লোকজনও ছিন্নভিন্ন। আমার সাথে আছে সহড়াতলার গোলাম মোস্তফা। পরবর্তীতে জোড়পুকুরিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা না হলেও আমাদের সহযোগী। তাকে আমরা সামরিক এবং রাজনৈতিক ট্রেনিং করিয়েছিলাম, প্রায়ই একই সাথে থাকতাম। দলের সকলে যখন পিছনের দিকে যাচ্ছে, তখন আমরাও পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিলাম। মাথা নিচু করে কোমর ভেঙ্গে আমরা গরিবপুরের দিকে রওয়ানা দিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তেই শত্রুপক্ষ আমাদের উদ্দেশ্য করে গুলি করা শুরু করেছে। তারই একটা গুলি গোলাম মোস্তফার দুই পায়ের মাঝখান ভেদ করে রাইফেলের বাটে লাগলো, কিছু অংশ ভেঙ্গে গেল। যদি গুলিটি আমাদের মাথায় লাগত, তাহলে কি অবস্থা হত? আমরা সামান্যের জন্য দুজনেই বেঁচে গেলাম।
মোজাম্মেলের রিপোর্ট অনুসারে ঐ দিনের যুদ্ধ সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত চলেছিল। আমার জানা মতে কোন গেরিলা যুদ্ধ এত দীর্ঘ সময়ী হয় না। শত্রু পক্ষ সংগঠিত হলেও তাদের গোলাবারুদ, খাবার দাবার ৫ ঘণ্টা চালানোর মত বহন করতে পারেনা। তদুপরি পাক আর্মিরা পায়ে হেঁটে এসেছিল, তাদের মিলিটারি গাড়ীটা মর্টার সহ জোড়পুকুরিয়া মাঠের মধ্যে বিকল হয়ে যায়। শুনেছি পাক বাহিনিরা করমদিতে ঢোকার সময় মাঠপাড়ার গ্রাম ডাক্তার নজিমুদ্দিন এবং আরো অনেককে দিয়ে গুলির বস্তা বহন করিয়েছিল।
মোজাম্মেলের সাথে ঐদিনই বিকেল বেলায় পলাশিপাড়ায় তৌফিক এলাহি চৌধুরী সাহেবের সাথে দেখা। তিনি শিকারপুর থেকে কিছু মুক্তিযোদ্ধা সাথে করে এসেছিলেন আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য, কিন্তু তার আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। তৌফিক এলাহি সাহেব মোজাম্মেলকে you are successful বলে প্রশংসা করেন এবং কাঁঠাল গাছের রক্তাক্ত পাতা দেখিয়ে বলেছিলেন অন্তত ৪/৫ জন পাক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধার গুলিতে নিহত হয়েছে। এই বিষয়টিও প্রশ্নবোধক। আহত হলেও তো রক্তাক্ত হতে পারে। ফল যাই ই হোকনা কেন, পাক বাহিনীর ক্ষতি হয়েছিল এটা সত্য। আর মুক্তিযোদ্ধাদের কেই-ই নিহত বা আহত হয় নাই, সেটাও ছিল সৌভাগ্য।
আজ এখানেই শেষ ২৭শে জুন, ২০২০
No comments